শিল্পের বারান্দায় বিজ্ঞান
হাসনাইন সাজ্জাদী
বিজ্ঞান বিষয়টি যান্ত্রিক হলেও তাত্ত্বিক। ল্যাব থেকে বিজ্ঞানের যাত্রা শুরু। তবে বিজ্ঞান মানবমনের কোণে শক্ত অবস্থান রাখে। জীবন এখন বিজ্ঞানে চলে। পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী গোটা বিশ্ব চলে। তাই এখন বললেও আগেই ছিল তার অবস্থান। কিন্তু বিষয়টি আমরা জেনেছি অতি সম্প্রতি। জীবন সৃষ্টির বেড়ে ওঠা, বিবর্তন এবং পরিণতি লাভ সবই পদার্থের রূপান্তর মাত্র। তাই যান্ত্রিক এবং ল্যাব নির্ভর হলেও বিজ্ঞান সতত চির জাগ্রত এবং চির বহমান। বিজ্ঞান নির্ভর বিশ্ব এখন বিজ্ঞানকেই শিল্প বলে জানে। বিজ্ঞান জানলে বিশ্বকে জানা হয়। নিজেকে জানা হয়। আর বিজ্ঞান না জানা থাকলে জীবন, বা জগৎ এবং নিজেকে জানা হয় না। অদৃশ্যের কাছে নিজেকে তখন সমষ্টিতে রেখে আধমরা থাকতে হয়। বিজ্ঞানবোধহীন থাকা মানে অচেতন থাকা। বোধহীনভাবে এ জীবনের নাম অবিজ্ঞানে অজ্ঞান।
সহজ ও সরল কথায় বিজ্ঞান ছাড়া যেমন জীবন চলে না তেমনি বিজ্ঞানহীন জীবনকে জীবন বলা যায় না। অসুস্থ, বিকারগ্রস্ত এবং অপ্রাকৃতস্থ যেকোনো কিছুই বিজ্ঞানহীন। শিল্পকে রসোত্তীর্ণ ভাবতে বাধা নেই। কিন্তু জীবনবোধহীন ভাবতে হয়না শিল্পকে।
আশ্চর্য দুর্বোধ্যতায় শিল্পকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অতীতে। বলা হয়েছে শিল্প বিমূর্ত কোনো কিছু। আলো-আঁধারের লুকোচুরিতেই শিল্প স্পষ্ট হয়। বিজ্ঞানের নতুন বোধে এখন তা ভাবনার অতীত হচ্ছে। মানুষের জন্য যদি শিল্প না হয়ে থাকে তবে তাকে কলাকৈবল্যবাদে আটকে রাখা যায়। দুর্বোধ্যতায় ঘেরাও করে রাখা যায়। যেমনটা এ যাবৎকালে হয়েছে। ফলে শিল্প থেকে গেছে মানুষের থেকে দূরে বহুদূরে।
শিল্পকে যদি বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত করে মানুষের জীবনে তার প্রয়োজনীয়তা তৈরি করা না যায়; তবে তা আগামী দিনে আরো গুরুত্বহীন এবং একাকীত্বের কিছু একটা হয়ে পড়বে।
শিল্পের ভঙ্গি থাকে না। শিল্পে থাকে ভাব ও রস। কবিতার মতো শিল্পকেও সময়োত্তীর্ণ, ভাবোত্তীর্ণ, রসোত্তীর্ণ হয়ে মানবজমিনে গুরুত্বপূর্ণ হতে হয়। শিল্পচর্চায় বিজ্ঞান ভাবনা অতিগুরুত্বপূর্ণ হয় করোনাকালে। বিজ্ঞান মানবজমিন তখন হয়ে ওঠে তীর্থভূমি। কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ধারামতে। হ্যান্ড ওয়াশ করা, সেনিটাজারে অভ্যস্থ হওয়া, মাস্ক পরিধান করা, শ্বাসকষ্ট হলে অক্সিজেন গ্রহণ ইত্যাদি তো বিজ্ঞানের নির্দেশনা ছিল। চিকিৎসা বিজ্ঞান মানব সভ্যতাকে রক্ষা করার জন্য যুগে যুগে ভাইরাস বিরোধী প্রতিরোধের অস্ত্র তুলে দিয়েছে মানুষের হাতে। শিল্প হচ্ছে জীবন বাঁচানো এবং জীবনকে সুন্দর করে পরিচালনার নাম। সুন্দরের মধ্যে রস আছে। আর বেঁচে থাকার মধ্যে আছে আনন্দ। বেঁচে থাকার মধ্যে আছে আবেগ। আবেগ, রস ও আনন্দ- এই তিনে শিল্প।
মার্ক্সবাদে মানুষের আবেগকে শিল্প বলা হয়। আমি যোগ করি বেঁচে থাকা এবং সুস্থ থাকাও শিল্প। যদি না বাঁচি বা যদি অসুস্থ থাকি তবে আমার জীবনে সৌন্দর্য থাকে না। মানে শিল্প থাকে না। জীবনকে বাদ দিয়ে, সুন্দরকে বাদ দিয়ে এবং সুস্থতা ছাড়া শিল্প হয় কী করে? কলাকৈবল্যবাদ বা অধরা শিল্প বা বিমূর্ততা কেনো শিল্পের মতো জীবনঘনিষ্ঠ স্থান দখলে রাখবে? আর্টকে ষোলো আনা সত্য এবং জীবনবোধে যুক্ত হতে হবে। আমার নিজস্ব চিত্রপথ আর নিজস্ব থাকে না তা যদি মানুষের প্রয়োজনে আসে এবং কল্যাণকর হয়। তা হলে শিল্প হচ্ছে বিজ্ঞান যাতে মানুষের কল্যাণ ও সত্য থাকবে। মানুষের প্রয়োজনের বাইরে যা হবে না। সবুজ প্রকৃতি চোখের জন্য নান্দনিক। জলছাপ এবং তেলরং মনে রসের যোগান দেয়। যেমন নারী পুরুষ মনে রসের যোগান দেয় এবং পুরুষ নারী মনের রসের যোগান দেয়। এখানে পুরুষ নারীর জন্য শিল্প এবং নারী পুরুষের জন্য শিল্প। যদি তা না করে উল্টো বিরক্তির উদ্রেক করে তবে তা কুরুচিপূর্ণ অ-শিল্প। শিল্পের মর্যাদায় তা পৌঁছেনি!
আমি যখন শিল্পের সংজ্ঞা তৈরি করছি তখনই মোবাইলে কল এলো আমার এক মেয়ে বন্ধুর। মেয়ে বন্ধু হলেও সে ছেলেদের মতোই স্মার্ট এবং সেক্সুয়াল রিলেশনে যেতে অনাগ্রহী। তার সম্পর্ক কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং তা দেহাতীত বা প্লেটনিক। তার সঙ্গে যারাই শারীরিক সম্পর্কে যেতে চেয়েছে সে তাদেরকে এমন সুন্দর করে নিবৃত্ত করতে পেরেছে যা শিল্প হিসেবেই দাঁড়িয়েছে। যাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং কাজের সম্পর্কে তারা জানে সে দেহাতীত একজন নারী। তাকে পাশে পাওয়া যাবে। কাছে রাখা যাবে, এক সঙ্গে কাজ করা যাবে। ভ্রমণ, গবেষণা, সংগঠন-সকল ক্ষেত্রেই তাকে একজন রুচিবান শিল্পী হিসেবে পাওয়া যাবে তবে যৌনশিল্প হিসেবে নয়। এটা কি সহনীয় শিল্পের বারান্দায়?
আবার কেউ আছে একটু নমনীয় এবং যৌন সম্পর্ক স্থাপনে চ্যুজি। দশজনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ভালো লাগলে কোনো একজন বা দু’জনের সঙ্গে সে অন্তরঙ্গ এবং গভীর সম্পর্কে আস্থাশীল হতে পারে। তার ক্ষেত্রে এটাই শিল্প। দু’ধরনের বান্ধবীর ক্ষেত্রেই শিল্পের বারান্দা উন্মুক্ত এবং সম্মানজনক সময়োত্তীর্ণ, কালোত্তীর্ণ, রসোত্তীর্ণ হয়ে শিল্পে পরিণত হয়েছে। দু’ভাবেই শিল্পরস আছে। দু’জনই শিল্পসঞ্চারী। চিত্তের শিল্প, কবিতার শিল্প আর ভাবনার শিল্প সবই জীবনের জন্য। জীবন সাজাতে, জীবন বাঁচাতে এবং জীবন রাঙাতে শিল্প হোক প্রাণোরস সঞ্চারী।
শিল্পের প্রধান লক্ষ্য জীবনকে জাগিয়ে দেয়া। উপ-প্রধান লক্ষ্যগুলোর মধ্যে জীবন বাঁচানো এবং জীবন সাজানোর কথা আসে। এটা পরিকল্পিত এবং জনমানসের মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত। পূর্ব-পশ্চিম এবং উঁচু মার্গ এবং নিম্নবর্গের কথা নয়। সবার জন্যেই এই সংজ্ঞা। প্রাচ্য রীতিতে শিল্পকলার উন্মেষকে এখন চর্চার কোনো মানে নেই। শিল্পের বাঁকবদলে প্রতিচ্য রীতি বা আমার বিজ্ঞান ধারণাই যুৎসই।
হতে পারে শহুরে শিল্প এবং গ্রামীণ শিল্পের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। শহরে জীবনের চাকচিক্যের শিল্পের রস আর গ্রামীণ শিল্পরস ভিন্ন। গ্রামে একজন কৃষকের নিকট তার স্ত্রী সাদা মাটা যৌন সঙ্গী। কিন্তু তার সঙ্গে রয়েছে হাটের ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি চিন্তা কিংবা ফসলী মাঠের নানা স্তরের সৌকর্য। সব মিলিয়ে গ্রামীণ জীবনরসও সমৃদ্ধ। বরং একজন গ্রামীণ নাগরিকের যৌনরস তার ফসলী মাঠের উন্নতি ও সুন্দরের সঙ্গে বিকশিত হয় কিংবা ফসলের মড়ক এবং ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষয়ক্ষতির সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ হতে বাধ্য। তবুও শিল্পীবন থেকে, জীবনের জন্য এবং তা কেবলই বিজ্ঞান।
মানচিত্রের সরলীকরণ বা নাগরিকের মৌল বিভাজন শিল্পরসকে ম্লান করতে পারবে না। প্যাটার্ন যাই হোক সামগ্রিক জীবন-ধারাতেই শিল্পধারা নিহিত। এখন অনেকে শিল্পের আলোচনায় ‘কন্টেক্সচুয়াল মডার্নিজম’ বলে একটি ধারার কথা বলেন। আমি বলি এসব বাদ দিন। ডাইরেক্ট ‘আর্ট সাইন্টিজম-এর কথা বলেন। শিল্প তাতে সমৃদ্ধ হবে এবং জীবন তাতে মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে। বাঁকবদল হবে মৌলিকতত্ত্বে। শিল্প হবে জীবন ঘনিষ্ঠ। তাহলে শিল্পে প্রকৃতির স্বরূপ খুঁজে পাওয়া যাবে ।
বিজ্ঞানশিল্পতত্ত্ব ও কবিতা
বিজ্ঞান থেকে জীবনের সুরক্ষা নিই আমরা। জীবনের গূঢ়রহস্য হিসেবে বিজ্ঞান তাহলে মোক্ষম। Science is art বা বিজ্ঞানকে শিল্প ধরে কলা কৈবল্যবাদের চর্চা এখন করতে হবে। লিও টলস্টয়ের কথা ধরে বলতে হয় ‘মানুষের আবেগই শিল্প।’ জীবনকে তাই সাজাতে হবে বিজ্ঞানের আলোকে। বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্বের মৌলিকত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের বিচারে পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্বের চুরচেরা কলাণমুখিতাকে গ্রহণ করতে হবে। পাশ্চাত্যকাব্যতত্ত্বে প্লেটো, এরিস্টটল, হোরেস, লঙ্গিনুসের কাব্যতত্ত্বের ধারাবাহিকতায় বাংলা কাব্যতত্ত্বে নান্দনিকতার আলোচনা শুরু হয়। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীসমউদ্দীন, আল মাহমুদ ও বিনয় মজুমদার বাংলা কাব্যতত্ত্বের প্রাত:স্মরণীয় নাম। কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতা কিংবা সমসাময়িক প্রয়োজনীয়তার আলোকে তাদের শিল্পের সংজ্ঞা বড়ো সেকেলে। এদিকে শামসুর রাহমানের কাব্যতত্ত্ব নাগরিক ও নান্দনিক। পদ্য থেকে কবিতাকে পৃথক করে তিনি বাংলা কবিতাকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছেন। আর কবিতায় নাগরিক চিহ্ন রেখে তিনি হয়েছেন আগামীর সারথী। ধরাবাঁধা ছকের বাইরে বিজ্ঞানকে মানুষের আবেগের মাপকাঠিতে তুলে ধরতে পারলেই কবিতাবিজ্ঞানের পথে হাঁটা সুগম হয়।
কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পে বিজ্ঞান থাকা, ছোটো ক্যানভাসে বড়ো উপমার প্রয়োগ, প্রতিবেদন ধরনের, মানুষের হাতে লেখা এবং মানুষের দ্বারা লেখা, কবিতায় সময়কে ধরে রাখা এবং ধর্মনিরপেক্ষ কবিতাকে বিজ্ঞানকবিতা বলা হয়।
বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্বের বিচারে বলা হয়, মানুষ একই নিউক্লিয়াস ও একই সাইটোপ্লাজম। মাতৃগর্ভ থেকে বিজয়ী হতে হতে মানুষ জীবন জয়ী। বিজয়ী মানুষদের ভ্রাতৃত্বের জন্য এ সমাজ। এখানে সবাই সমান। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ সামাজিক বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে। কবিদের কাজ হবে কবিতার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা জাগ্রত করা, যাতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করতে কবি ভূমিকা রাখতে পারে।
সভ্যতার অগ্রযাত্রায় কবিতা এখন থেকে মানবতার বাণী প্রচার করুক। ঐতিহ্যিক ও ঐতিহাসিকভাবে কাল বিবেচনায় আমাদের শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে দিতে আমার হাতে (হাসনাইন সাজ্জাদী) বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব, বিজ্ঞানশিল্পতত্ত্ব সাবলীল ছন্দের প্রবর্তন করা হয়েছে। যথাযথ আধিপত্য নিয়ে বিজ্ঞান এখন জাগরিত এক বাস্তবতা। পরীক্ষাগারে নিরূপিত তত্ত্বে বিজ্ঞান পেয়েছে সমৃদ্ধি। তাই যুগটা এখন বিজ্ঞানের। বিশ্ব এখন আন্তঃজালে বন্দি। তাই বিজ্ঞানকবিতার জন্য সুনির্দিষ্ট কাব্যতত্ত্ব আবিষ্কার হয়েছে। বিজ্ঞান সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি করা হয়েছে বিজ্ঞানবাদরাষ্ট্রতত্ত্ব। কবিতাবিজ্ঞান মৌলিক বিজ্ঞানের একটি ফলিত শাখা হিসেবে স্বীকৃতির লড়াই করছে। মৌলিক বিজ্ঞানের চারটি প্রধান শাখা ফলিত রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিদ্যা ও মহাকাশবিজ্ঞান (জ্যোর্তিবিদ্যা) নিয়ে সমৃদ্ধ লাভ করেছে কবিতাবিজ্ঞান। বিজ্ঞানের মৌলিক মানসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এবং বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারের কাজে আসে এমন কবিতাকে কবিতাবিজ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। মানুষ মাটির তৈরি নয় কিংবা সূর্য পূর্বদিকে ওঠে না বিজ্ঞান বলে। নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম নিয়ে মানুষ তৈরি। মানুষের দেহে মাটি নেই। আবার ভোরবেলা আমরা সূর্যের নিকট পৌঁছি। তার পর নিজস্ব কক্ষপথে মাথার ওপর তুলে নেই সূর্যকে। বিকেল বেলা পশ্চাতে ফেলি আবার রাতে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে পৌঁছি। তাই দিনরাত ও সকাল-সন্ধ্যার এ পরিক্রমণ জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে প্রাপ্ত। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠেছে’ কিংবা ‘মাটির দেহ খাইলো ঘুণে’ বলার অবকাশ নেই। পরীক্ষাগারে নিরূপিত সত্যছাড়া কবিতার সত্যদ্রষ্টা ও ক্রান্তদর্শী হওয়া যাবে না। বিজ্ঞান আত্মাকে স্বীকার করেনা। বিজ্ঞান অসুখে ওষুধ প্রেসক্রাইব করে। বিজ্ঞান মানুষের অগ্রযাত্রায় অবলম্বন তৈরি করে দেয়। আবিষ্কার ছাড়া সভ্যতা এগোয়নি। চাকার আবিষ্কার সভ্যতার অগ্রযাত্রায় প্রথম অবলম্বন। তারপর আসে কৃষি বিপ্লব ও শিল্পবিপ্লব। তারপর এসেছে বিজ্ঞানের প্রাগ্রসরতা। সব মিলিয়েইতো আমাদের পূর্ণতা।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলা হয় আইনস্টাইনকে। সৌমেন হাজরা অনূদিত আইনস্টাইনের একটি কবিতা যেমন-
‘প্রকৃতির রয়েছে বক্রতা ভীষণ
স্থান-কালও নয় নিত্য,
সরলরেখারা যেনো সোজা নয়
গোলাকার নয় কোনো বৃত্ত।
কারণ স্যার আইজাক নিউটন
যদিও অতি মহামান্য।
মাধ্যাকর্ষণের ধারণাটা তার
এতদিন ছিল অসম্পূর্ণ।’
মূল কবিতা-
‘A Warp in nature has been found
no line is straieght no circle Round
For isace newton had unsound
ideas of gravitiation.’
বিজ্ঞানী এপিজে আবুল কালামের কবিতা-
‘আকাশের পানে চালিত করার এক বস্তু
কিংবা অশুভ শক্তির প্রতিরোধ হিসাবে
অগ্নির দিকে তাকিয়ে দেখো না।
এ হলো এক ভারতীয় হৃদয়ের স্ফূলিঙ্গ
না, ক্ষেপনাস্ত্রের রূপেও একে ভেবো না।
এ যেনো ঘিরে আছে জাতির জ্বলন্ত গৌরবকে
আর সেই-ই তার একমাত্র উজ্জ্বলতা।
(উইংস অব ফায়ার, বাংলা অনুবাদ, পৃষ্ঠা : ‘১৭৫)।
এগুলো হলো বিজ্ঞানমনস্ক কবিতা। সরাসরি কবিতা বিজ্ঞানে পৌঁছুতে হলে উদ্ধৃতি হিসেবে বাংলাসাহিত্যেল সাম্প্রতিক অন্যতম জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার উল্লেখ করা যায়-
‘পৃথিবীর যে স্থির নয়, সে-কথা আমি আগেও জানতাম।
সূর্যকে কেন্দ্র করে মহাশূন্যের কক্ষপথে সে ঘুরছে।
পৃথিবী হচ্ছে অন্ধকার ম্যাজিক-মঞ্চে কালো সুতা দিয়ে
ঝুলিয়ে রাখা, উত্তর দক্ষিণে চাপা এক কৃষ্ণ কমলালেবু
কালো সুতোটা সাধারণের চর্মচোখে দেখা যায় না, কিন্তু আছে।
আমি যখন পৃথিবীর দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই
ফলের দোকানের সুতোবাঁধা আপেলের মতো পৃথিবী ঝুলছে।
(নির্মলেন্দু গুণের কবিতা, পৃষ্ঠা : ৮৬-৮৭)
এখানে কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে কবিতাবিজ্ঞান এবং একই সঙ্গে মহাকাশ বিজ্ঞান জানা যায়।
শুদ্ধতার কবি অসীম সাহার কবিতায় যেমন-
‘তোমার আকাশে নক্ষত্র হয়ে জ্বলে উঠবো বলেইতো
এতটা রাত অব্দি জেগে আছি।’ (তোমার আকাশে/অসীম সাহা)
আকাশে নক্ষত্র জ্বলে ওঠা মহাকাশ বিজ্ঞানের অংশ। এটাও কবিতাবিজ্ঞান হবার পাশাপাশি ফলিত বিজ্ঞানের বিজয় ঘোষণা করে।
কবিতা বিজ্ঞানকে মুজিবময় বাংলার কবি মুহাম্মদ সামাদ অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন তাঁর ‘প্লুটোর জন্য এলিজি-তে। তিনি লিখেছেন-
ছোটবেলায়, আকাশে জোনাকপোকা আর তারাদের ছুটোছুটি দেখলে
ওদের যে কাউকে প্লুটো, নেপচুন অথবা মঙ্গলগ্রহ ভেবে খুব আনন্দ পেতাম
পিঠাপিঠি ভাই-বোনের মতোই গলগালি করে বেড়ে উঠেছি আমরা
প্লুটো আমাদের সঙ্গে কতো লুকোচুরি খেলেছে সন্ধ্যায়!
এখন জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ অনর্থক প্লুটোর পেছনে
উঠে পড়ে লেগেছে; তাদের অজুহাত-
প্লুটো তার প্রতিবেশীদের গ্রাস করতে অক্ষম;
সে বিশ বছর পর-পর আবার নেপচুনের কক্ষপথের মধ্যে ঢুকে যায়
এবং সে নাকি আকারে বামন; তাই, গ্রহের মর্যাদা তার আর নেই।
…গোবেচারা প্লুটো নেহাৎ পুরনো আত্মীয়তাসূত্রে
বিশবছর অন্তর একবার নেপচুনের আঙিনা ভ্রমণ করলে
কার কী এমন ক্ষতি, শুনি?
গ্রহ নক্ষত্রেরাও তো পরস্পর ছোট বড় ভাই-বোন, প্লুটো বয়সেও ছোট
আমি বলি আমরা তো ছোটো ভাই-বোনদের জুতোর ফিতেয় ফুল তুলে দেই
লাল টুকটুকে রিবনের ঝুটি করে স্কুলে পাঠাই, বেড়াতে নিয়ে যাই
পার্কে, নদী তীরে
তাহলে ইরাক যুদ্ধের মতো খোঁড়া যুক্তির আড়ালে
প্লুটোর প্রতি এ-নির্দয়তা আমাদের সাজে?
এই ক’টা দিন থাকি-না আমরা মিলেমিশে মাটিতে আকাশে
(প্লুটোর জন্য এলিজি, মুহাম্মদ সামাদ)।
হ্যাংরি জেনারেশনের অন্যতম কবি ফাল্গুনী ভট্টচার্য। বিজ্ঞানযুগের ‘কবিতাবিজ্ঞান’ তাকেও আচ্ছন্ন করে। হ্যাংরি ছেড়ে তিনিও কবিতাবিজ্ঞান লেখেন-
‘… মোবাইলের টক টাইমও শেষ হয়ে
তোমার আমার মধ্যে এখন
সাগর অনিঃশেষ…
(টকটাইম ফুরিয়ে আসছে, ফাল্গুনী ভট্টাচার্য)।
এক সময় হ্যাংরি জেনারেশনের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে পড়েছে এটা যেন ফাল্গুনী ভট্টাচার্য জানেন তেমনি আজ যারা উত্তরআধুনিক কিংবা উত্তরউপনিবেশিক কবিতা লিখছেন তারাও কবিতাবিজ্ঞান লিখবেন- এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিজ্ঞানমননে বুঝতে হবে বিজ্ঞানচিত্রকলা। বর্তমান আমাদের নিকট বিবেচ্য। জীবনেরও রঙ যেখানে ফ্যাকাশে। সেখানে আমরা আমাদের অস্থি-মজ্জা ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ঘাটতি থেকে রক্ষা করছি বিজ্ঞানে। আমরা নিজেদেরকে নিরোগ রাখছি বিজ্ঞানে। রক্তে ভেজাল আর অক্সিজেনের অভাব হলে তা বিশুদ্ধ করি বিজ্ঞানে আমরা। তাহলে বিজ্ঞানের বাইরে যাবার মতো অপরিণামদর্শিতা আমাদের এড়িয়ে চলতে হবে। বিজ্ঞান যখন জীবনের জন্য বিশেষ বেগ, সেখানে হালকা চটুল আনন্দের আবেগে কবিতাকে বন্দি না করে বিজ্ঞানের বেগে মুড়ে দিলে কবিতাবিজ্ঞান হবে যুৎসই ও কার্যকর শক্তি।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইয়ুথ পোয়েট লরিয়েট (২০১৭) আমান্ডা গোরম্যান যেমন জো-বাইডেনের অভিষেকে পঠিত কবিতায় সত্য এবং আগাম বলেছেন-
‘হাড্ডি-চর্মসার কৃষ্ণাঙ্গ’ মেয়ে যার স্বপ্ন প্রেসিডেন্ট হওয়ার।
যার পূর্ব পুরুষ ছিল দাস এবং বড়ো হয়েছে একাকী মায়ের হাতে-
‘…আমরা এমন শক্তি দেখেছি, যা আমাদের দেশকে
সবার মধ্যে বিলিয়ে না দিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে,
গণতন্ত্রকে বিলম্বিত করাতে পারলে দেশকে ধ্বংস করে দিবে।’
এমন চেষ্টা প্রায় সফলও হয়েছিল। গণতন্ত্র হয়তো সময়ে সময়ে দেরিতে আসতে পারে, কিন্তু একে কখনোই স্থায়ীভাবে পরাজিত করা যাবে না। এটা পোস্টকলোনিয়াল বা উত্তর ঔপনিবেশিক কবিতা। এটাকে উত্তরআধুনিকরাও বলবেন তাদের মতো কবিতা। কিন্তু সময়কে ধরে রাখার ফলে বিজ্ঞানমনস্ক কবিতা ও বিজ্ঞানকবিতায় বিজ্ঞান সময় লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অপর সম-সাময়িক প্রধানকবি জিরাল্ড টার্নের স্বগোক্তির কথা আবার আমি স্মরণ করিয়ে দিতে পারি। যেখানে তিনি বলেছিলেন আমার কবিতায় আমি আমার সময়কেই ধরে রাখতে চেয়েছি। বর্তমানই আমার কাছে মূল বিবেচ্য বিষয়। তাহলে জীবনের কাছে। যেমনি ফিরে আসতে হয় তেমনি সময়ের সঙ্গেও এগিয়ে চলতে হয়। তাহলে বিজ্ঞানেই থাকতে হয়।
অতীতের কবিতায় সমসাময়িক বিশ্ব ও এবং সময়ের অনুপাতে বিজ্ঞান থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তা বিজ্ঞানকবিতা নয়। কারণ বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতা লক্ষ্য করেনি অতীত। আজকের মতো বিজ্ঞান কোনোদিন ছিল কী? আধুনিকতাকে সব সময় যারা কবিতার জন্য আধুনিক বলেন, তারা কি জানেন না শত বছর আগে মানুষ কম্পিউটার, ইমেল, ইন্টারনেট, টিভি, ল্যাপটপ, জেরক্স, ফোন, মোবাইল, (স্মার্টফোন, এনড্রয়েড আইকোন) প্রোজেক্টর, যাবতীয় ইলেকট্রনিক উপকরণ মাধ্যমে, ইলেক্ট্রনিক্স উপাদান, জিন প্রকৌশল, মাইক্রো প্রসেসর, ন্যানো টেকনোলজি, কোয়ান্টাম থিয়োরি, প্লাস্টিক শিল্প ও পেট্রো ক্যামিক্যল প্রভৃতি জানতো না। কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ‘বিশ্বটাকে দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’ বলে হয়তো একটি বিপ্লবের কল্পনার প্রসেস করছেন বিজ্ঞানবাদের মস্তিষ্কে। কবি প্রভাবিত বিজ্ঞানী সমাজ তখনই হবেন যখন কোনো কবি স্কেনিং লিফট, রিমোট সেন্সিং, লিপরিডিং মেশিন, ফ্লাই জ্যাকেটের উপমা বলবেন। তখন বিজ্ঞানীরা তার থেকে আগামীর নকশা পাবেন। তখন যদি কেউ কাউকে বিজ্ঞানী বলে তাতে বাধা নেই। কিন্তু যে কবি আবেগে প্রেমিকের চিবুকের তিলের বিনিময়ে সমরখন্দ, বোখারা প্রভৃতি দিয়ে দেবার ঘোষণা দেন তাকে তো আর বিজ্ঞানকবি বলা যাবে না। তাহলে কোটি কোটি কবির মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন কবি হবে বিজ্ঞানকবি। অন্যরা নয়। বাকিদের কবিতায় যদি বিজ্ঞান না থাকে তবে তাদের ক্ষেত্রে কবিরা বিজ্ঞানের নকশা করেন আর বিজ্ঞানীরা তার বাস্তবায়ন করেন বলা যাবে না। আবেগে বিনোদন দিয়ে যারা নিজেদের কর্মক্ষেত্রকে অলসতায় ভরে দিচ্ছেন, তাদের কী করা উচিত? পিঠিয়ে পেদিয়ে অলস ও পুষ্টিহীন অবিজ্ঞান কবিদের ধানচাষ, পোলট্রি ফার্ম কিংবা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে পাঠানো উচিত। যাতে তারা উৎপাদনশীলতায় যুক্ত হয়ে নিজের, নিজের পরিবার পরিজনদের এবং দেশের উপকারে আসে। প্রকৃতি প্রদত্ত জ্ঞান ও সময়কে যাতে তারা বিজ্ঞানবিরোধীতায় না লাগাতে পারে সে বিষয়ে দৃষ্টি দেয়ান জন্য একটি কবিতা কর্তৃপক্ষ গঠন দরকার। বই বেরোনোর আগেই যারা সেন্সর করবে। ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের মতো কবিতা সেন্সর বোর্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতি বছর ৭-৮ হাজার কবিতার বই প্রকাশের দরকার নেই। ৭-৮ শত বইই প্রচুর ধরে নিতে হবে। যেকোনো বিষয়ে প্রকাশনার পূর্বে সেন্সর বোর্ডের দ্বারস্থ হতে হবে। অন্তত পাঁচ জন রিভিউয়ার এর রিপোর্ট লাগবে একটি বই প্রকাশের পূর্বেÑতাহলে অপদার্থ লেখকরা দাবি করতে সাহস পাবে না যে, কবি মাত্রেই বিজ্ঞানী। কবিতামাত্রেই বিজ্ঞান বলে কবিতার বিজ্ঞান আন্দোলনকে তারা পৃষ্ঠদেশে ছুরিকাহত করতে সাহস দেখাতে পারবে না।
মগজে, কালিতে ও সময়ের দিক থেকে অ-বিজ্ঞান চিন্তার লেখালেখিতে যে অপচয় হচ্ছে তাতে দেশের অর্থনীতির একটি বড়ো অংশের ক্ষতি হচ্ছে। তা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে না পারলে অচিরেই প্লেটোর মতো কোনো তাত্ত্বিকের উদ্ভব হতে পারে যিনি পুনরায় কবিদেরকে নির্বাসনে পাঠাতে পরামর্শ দিতে পারেন।
গ্লোবাল ভিলেজে আমাদের বসবাস। শিল্পকৌশল (Art Engineering), শিল্পবিজ্ঞান (Scientific Art), তত্ত্ব (Theory) প্রভৃতি এখন আমাদের হাতের নাগালে। সেখানে বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব, বিজ্ঞানশিল্পতত্ত্ব ও বিজ্ঞান রাষ্ট্রতত্ত্ব ব্যতিত কবিতার ছন্দ, ব্যাকরণ রপ্ত করার মানে নেই। সংস্কৃতির ভাবনায় এখন বিজ্ঞানমনস্কতা সময়ের দাবি। মস্তিষ্কের ভূমিজ, কালিক এবং শৈল্পিক চেতনায় বিজ্ঞান ছাড়া বিকল্প কোনো তত্ত্ব আর গ্রহণযোগ্য নয়, হতে পারে না। সিলিকন ভ্যালির আলোর ঝলক আমাদেরকে আগামীতে সাইবোর্গ যুগে নিয়ে যেতে হাতছানি দিচ্ছে। স্ক্রিনে আমরা নিজেদেরকে স্থানান্তরিত করছি। আসছে গুগল জেনারেশন। বিজ্ঞানযুগ তখন সাইবোর্গ যুগে পদার্পণ করছে। তখন অন্য কবিতা লিখতে হবে। সেটা উত্তরবিজ্ঞান কবিতা নয়, যেমন উত্তরআধুনিক ও উত্তরঔপনিবেশিক কবিতা বলে কিছু আজ কিছু নেই, থাকতে পারে না।
উত্তরআধুনিকতা, উত্তরঔপনিবেশিকতা না বিজ্ঞানকবিতা!
সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হলে ভেঙে পড়ে বার্লিন প্রাচীন। অর্থাৎ ভেঙে দেয়া হয় জনতার আবিষ্কারকে বাধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসে। তাতে পুঁজিবাদ নিশ্চিত হয়। কেউ কেউ হন উচ্ছ্বসিত এবং কারো কারো হতাশা বাড়তে থাকে। এমনি পরিস্থিতি ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা পুঁজিবাদীদের আশ্বাস্থ করেন এই বলে যে, ‘পৃথিবী যতদিন থাকবে, মানুষের সমাজ ও রাষ্ট্র যতদিন থাকবে, ততদিন তারা জীবনযাপন করবে পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যেই’।
এমন একটি পরিস্থিতিতে নতুনভাবে মানুষের অধিকার, মৌলিক চাহিদা পূরণের দাবি এবং মানবেতন জীবনযাপন থেকে মুক্তির প্রচেষ্টাকে চলমান রাখতে নতুন করে ভাবনা শুরু হয়। স্বল্প সংখ্যক মানুষের হাতে যখন সম্পদ ও ভোগের নিশ্চয়তা নিয়ে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা অন্ধকারকে আলোর সারথী ভেবে মার্কসবাদের পতনকে চিরস্থায়ী ভাবতে গিয়ে আহ্ললাদিত হন তখন বিজ্ঞানবাদের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে আসতে হয় আমাকে। মার্কসবাদ থেকে উত্তম এবং মওদুদীবাদ (রাজনৈতিক ইসলামের অর্থনীতি ও রাজনীতি) থেকে প্রাগ্রসর এক মতবাদ বিজ্ঞানবাদ। বাইশ শতকের ঠিক দিকনির্দেশনামূলক সুবিচার, শোষণ মুক্তি, মানবাধিকার, রাষ্ট্রবিহীন মানুষের অধিকার এবং বিশ্বরাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি করি আমি বিজ্ঞানবাদ। রাষ্ট্র, মালিক পক্ষ এবং শ্রমিকদের মধ্যে সমানুপাতিক হারে সম্পদের তিনভাগে বণ্টন, শ্রমিকদের বেতনভাতা পরেও এক তৃতীয়াংশের মালিকানা বসানো এবং সরকারকে কল্যাণমুখী কাজের জন্য এক তৃতীয়াংশ ছেড়ে দিয়ে পুঁজিবাদকে বিজ্ঞানবাদে সহজ ও সাবলীলভাবে বিলীন করে দিয়ে আগামী বিশ্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন রয়েছে বিজ্ঞানবাদে। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার স্থলে যখন বিশ্ব রাজনৈতিক তত্ত্ব বাংলাদেশের কারো (হাসনাইন সাজ্জাদী) হাতে ডালপালা গজাতে সাহায্য করে তখন শ্রমিক শ্রেণির অধিকার এবং পুঁজিবাদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিকে ফুটো বেলুনের মতো শূন্যে ফাটিয়ে দেয়া সহজসাধ্য হয়ে পড়ে। কেউ কেউ অবশ্য এমতাবস্থায় মার্কসবাদের সমসাময়িকীকরণ ও তার সৃজনশীলতাকে আড়ালে রেখে নতুন মোড়কে ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করতে গিয়ে উত্তর আধুনিকতার জন্ম দেন। এখনো সন্দিহান তত্ত্বের ধোঁয়াশা দূর করার লড়াইর রামায়ণের মতো মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধরত মেঘনাদের মতো। নিজেকে আড়ালে রেখে যুদ্ধ চালানোর অবস্থা-বিষয়ে অনেকের নিকটেই উত্তরআধুনিকতার ধোঁয়াটে চরিত্র বড়ো অপরিপক্ষ। ভাবনায় মার্কসবাদকে এগিয়ে নেবার দায়িত্ব কাধে এবং পাশ কাটিয়ে নতুন নামের আড়ালে বিভ্রান্তির হাঁটাচলা ভাবধারায় মার্কসবাদ থাকলেও কর্মে যখন এড়িয়ে চলা হয় মার্কসবাদকে এবং শ্রেণিদ্বন্দ্বকে সম্পূর্ণভাবে পাশ কাটিয়ে চলা হয়, তখন খণ্ড খণ্ড ইস্যুর আন্দোলন এবং সংলাপের আহ্বান ছাড়া উত্তরআধুনিকতা না কোনো সম্পূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন হয়। না হয় শৈল্পিক কোনো ভাবনা। নান্দনিকতাহীন পথচলায় আবার খোঁজা হয় বিমূর্ত নন্দনতত্ত্ব। অথচ করোনাবিশ্ব দেখিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞানশিল্পতত্ত্ব ছাড়া মানবজাতিকে রক্ষার আর কোনো পথ নেই। এভাবনা থেকেই আমি বিজ্ঞানবাদের সম্পূরক হিসেবে বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব, বিজ্ঞানশিল্পতত্ত্ব এবং সাবলীল ছন্দ নিয়ে কবিতাবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠা করেছি। উত্তরআধুনিকতা এখানেই চুপসে যাওয়া বেলুন এবং বিজ্ঞানবাদ তদস্থলে উদীয়মান বাঘ। বিজ্ঞানবাদ যেখানে রাজনৈতিক এবং শৈল্পিকতত্ত্ব ও মতবাদ হিসেবে অগ্রসরমান তখন উত্তরআধুনিকতাকে কোনো রাজনৈতিক ও সাহিত্য দর্শন হিসেবে গ্রহণ করা যায় কিনা-না তা নিয়েও সংশ্লিষ্টরা সন্দিহান। অথচ বিজ্ঞানবাদে বলে দেয়া হয় দর্শন ছিল যুক্তি ও বুদ্ধির সমন্বয়চিত্র। তাই তা আর সচল থাকতে পারে না। তদস্থলে পরীক্ষাগারে নিরূপিত সত্য এবং বিজ্ঞানের ৪টি মৌলিক শাখায় আবর্তিত পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, রসায়নবিদ্যা এবং জ্যোর্তিবিদ্যা হলেই কেবল তা তত্ত্ব হিসেবে বিবেচতি হবে যা বিজ্ঞানবাদ নামে পরিচিত।
যদিও এক সময় মার্কসবাদের সৃজনশীল ব্যাখ্যার কথা বেশ জোরেশোরে আলোচিত হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগে থেকেই ফ্রাঙ্কফোর্ট স্কুলে এবং আন্তনিয় গ্রামসির সর্বব্যাপী মৌলিকতত্ত্ব মার্কসবাদের সৃজনশীলতার কথা আমাদের প্রভাবিত করতে চাইতো।
কারো কারো অবশ্য ক্ষমতার দ্বন্দ্বে হেরে গেলে সংশোধনবাদ বলে উঠে পড়ে লাগা অপর রাষ্ট্র বা পার্টি ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হলে তাকেই মার্কসবাদের সৃজনীশীলতা বলে হাঁকাতেন না তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন তাও এখন ভুলিয়ে দিচ্ছে পুঁজিবাদের একচ্ছত্র অগ্রযাত্রা। অথচ সমাজতান্ত্রিক দেশের প্রযুক্তিসর্বস্বতা, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উদ্ধত প্রভূত্ব, শুধুমাত্র উৎপাদনকেন্দ্রিক ব্যবস্থা, বৃহদায়তন রাষ্ট্র, বিপুল আমলাতন্ত্র, শিল্প সভ্যতায় প্রাচুর্য ও লোভের সাধনা, সর্বনিয়ন্ত্রক কমিউনিস্ট পার্টিতন্ত্র, কঠোরতম শৃঙ্খলার নামে সবকিছুর কেন্দ্রিভবন, রাষ্ট্রে পুলিশের সার্বক্ষণিক নজরদারি ও গুপ্ত কেজিবির দাপট, সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির ওপর রাষ্ট্রের মাতব্বরি, ব্যক্তি স্বাধীনতা দমন, অথচ লেনিন, স্টালিন ও মাও প্রমুখের ব্যক্তিপূজা, হাঙ্গেরী, চেকোস্লাভাকিয়া, আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্য, বেজিং এর তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে গণতন্ত্রকামী ছাত্র আন্দোলনের উপর ট্যাংক বহর চালিয়ে দেয়া ও নির্বিচারে গুলিবর্ষণকে বৈজ্ঞানিক শিল্পতত্ত্বের আলোকে দেখা হয়নি কখনো। পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্যের কারণে এমনকি ইউক্রেনে সাম্প্রতিক রাশিয়ার হামলাকে সমালোচনা করার জো-নেই। তাতে উত্তর আধুনিকতা মার্কসবাদের সহায়ক না হয়ে দ্বান্দ্বিক বিভ্রান্তবাদে পরিণত। যদিও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন এবং বিশ্ব পুঁজিবাদ রাজনীতির একচ্ছত্র বিকাশমান ধারায় মার্কসবাদকে বাঁচাতে উত্তরআধুনিকতার সৃষ্টি। কিন্তু উত্তরআধুনিকতার প্রবক্তারাই তাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে নানা বিভ্রান্তি তৈরি করে রেখেছেন। মিশেল ফুকো, জাস্ক দেরিদা, জাক লাকাঁ, ফ্রাঁসোয়া লিওতার, বলাঁ বার্ম, দ্যলুজ গুয়াত্তারি, বদ্রিলার পল ডিম্যান, লুস ইরিগারে, জুলিয়া ক্রিস্তেভা, হেলেন সিকসু, ইহাব হাসান, চার্লস জেঙ্কস, রবার্ট ভেনচুরি, রিচার্ড রোবটিসহ উত্তরআধুনিকতার বিভিন্ন তাত্ত্বিক কোনো সংজ্ঞায় উত্তর আধুনিক মতাদর্শকে সংজ্ঞায়িত করতে চান না। বিপত্তি আরো রয়েছে, সবকিছু ভেঙে ফেলে নতুন করে গড়তে চান তারা কিন্তু তা কীভাবে তা তাদেরও বোধের অতীত। বিরুদ্ধবাদীরা তাই কঠিন সমালোচনা করতেও ছাড়েননি তার। ক্যালিনিকোস ও এজাজ আহমেদ উত্তরআধুনিকতাকে পুঁজিবাদের বৌদ্ধিক অস্ত্র বলতেও ছাড়েন নি। আমি (হাসনাইন সাজ্জাদী) মনে করি উত্তরআধুনিক চিন্তার মধ্যে রয়েছে বিশ্বায়নের দালালী। মার্কসবাদী সাহিত্য সমালোচক টেরি ইগলটন উত্তরআধুনিকতাকে পুঁজিবাদের তত্ত্ব হিসেবে মনে করেন। ডেভিড হারভে ‘দ্যা কন্ডিশন অব পোস্ট-মডার্নিটি’তে উন্নত ধনতন্ত্রের বিকাশ লক্ষ্য করেছেন। জোয়ার বাজারের ফটকাবাজী, অনুৎপাদনশীল সম্পদের প্রসার, আর তার সঙ্গে তত্ত্ব প্রযুক্তির অকল্পনীয় উন্নতি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্যাটেলাইট প্রভৃতির সঙ্গে উত্তরআধুনিকতার উদ্ভাবনকে অনেকে সমন্বয় করে থাকেন।
ধনতন্ত্রের এক বিশেষ পর্বে উত্তরআধুনিকতার উদ্ভব। পূর্ব ইউরোপ ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্রের পতন উত্তরআধুনিকতাকে উৎসাহ যুগিয়েছে বলে অনেকে বলে থাকেন। তবে এমতের সঙ্গেও ভিন্নমত পোষণ করেন ফ্রেডরিক জেসমন। তাকে উত্তরআধুনিকতার প্রতি যথেষ্ট আগ্রহী এবং একই সঙ্গে কড়া সমালোচক মনে করা হয়। তিনি মনে করেন উত্তরআধুনিকতা হচ্ছে পুঁজিবাদের বিলম্বিত সাংস্কৃতিক যুক্তি।
উত্তরআধুনিকতা মূলতত এক বিভ্রান্ত মতাদর্শ। তারা ম্যাটান্যারেটিভ বিশ্বাস করেন না, ইতিহাসের এক রৈখিকতায় ও তাদের বিশ্বাস নেই, পুঁজিবাদের অনাচার থেকে সমাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনেও তাদের বিশ্বাস নেই। তাতে তাদের দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পায়। নির্দিষ্ট অর্থ জানা বা সারকথায় অবস্থান গ্রহণে যেহেতু তাদের ইচ্ছে নেই তাই তাদের সংজ্ঞা নিরূপণেও আগ্রহ কম। তাই একেক দলের বা একেক ব্যক্তির কাছে উত্তরআধুনিকতার অর্থ একেক রকম। বোঝাটাও তখন সাবজেকটিভ। অবজেকটিভ বা বস্তুনিরপেক্ষতাও তাদের ভাবনায় নেই।
একজন লেখক তার টেক্সট কি অর্থে বা ভাবনায় লিখেছেন তা নয়। বরং পাঠক সেটাকে কিভাবে দেখছে সেটা উত্তর আধুনিকতায় গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব বা বিজ্ঞানচিন্তাভাবনায় যেহেতু নির্ধারিত থিয়োরি ফলো করা হয়, পরীক্ষাগার থেকে তত্ত্ব উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়, তবে সেখানে লেখক-পাঠকের মধ্যে খুব বেশি দূরত্ব হবার সুযোগ নেই।
উত্তরআধুনিকতার প্রবক্তারা আরো বিভ্রান্তি ছড়ান যখন তারা বলেন, হেগেল বা মার্কস’র ইতিহাসবাদ, যারই হোক না কেন তাদের কাছে তা পরিত্যাজ্য। তারা বিশ্বাস করেন না লিবারেল ডেমোক্রেসি। সার্বিক আন্দোলন বা আন্দোলন থেকে প্রাপ্ত ব্যক্তি স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠায়ও তাদের আস্থা নেই। শোষণমুক্তি, দারিদ্র দূরিকরণ শ্রেণিবৈষম্য দূর প্রভৃতির জন্য সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনেও তাদের আস্থা নেই। এগুলোকে তারা বাস্তব মনে করেন না। অধিবিদ্যাগত কল্পনা বা বায়বীয় মনে করেন তারা। আন্দোলনের যেমন ক্ষেত্র নেই বলে তারা মনে করেন তেমনি তাদের ধারণা আন্দোলন থেকে উপকৃত হবার কোনো সুযোগ নেই। তাদেরকে হতাশাবাদী, বিভ্রান্তিবাদী এবং স্বপ্নহীন বলা যায়। তাদের কাছে নিকট বিশ্বে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া বাংলাদেশের ইতিহাসের কোনো গুরুত্ব নেই। স্বপ্ন তারা দেখেনা। স্বপ্ন দেখিযে দুঃসাধ্য কাজকে সাধন করার ইতিহাসও তারা মানে না। বিজ্ঞানবাদের একটি স্লোগানই হলো- ‘আমাদের আছে স্বপ্ন, আমাদের আছে লক্ষ্য’। স্বপ্ন দেখিয়ে অসাধ্য কোনো কাজকে সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসা এবং মানবজাতির উন্নয়নে স্বপ্নকে কাজে লাগানোর কথা বলে বিজ্ঞানবাদ বলতে গিয়ে তা বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্বে উত্তীর্ণ হয়। আগেই বলেছি, তারা অব্যবস্থাপনা থেকে বেরিয়ে আসার পথ জানেন না, মানেন না এবং তা সহজসাধ্য ভাবেনও না। তাদের দুঃখ, দারিদ্র্য, শোষণ, অবিচার, দুর্দশা থেকে চিরতরে মুক্তির কোনো পথ নেই, তাই স্থানীয় ইস্যুতে ক্ষুদ্র প্রতিরোধে তারা সমর্থক।
‘হিরক রাজার স্লোগানÑ‘জ্ঞানের কোনো শেষ নাই, জ্ঞানের চেষ্টা বৃথা তাই’ কে তারা মনে করে আগামী বিশ্বেও তাই কার্যকর। তাই ‘সংলাপ তাদের নিকট কার্যকর আন্দোলন থেকেও।’ মার্কসবাদ সম্পর্কে তাদের অনীহার কারণ সেখানে শুধু শ্রেণি সংগ্রামের কথা বলা হয়েছে। এর বাইরেও যে মানুষ শোষিত হচ্ছে তা নিয়ে তাদের অজ্ঞতাকে উত্তর আধুনিকতাবাদীরা বড়ো করে দেখেন। ধর্মীয় শোষণ, বর্ণপ্রথার শোষণ, গাত্রবর্ণের শোষণ, লৈঙ্গিক শোষণ, জাতীয়তাবাদী শোষণ, প্রভৃতিকে মার্কসবাদ এড়িয়ে গেছে বলে তারা মনে করেন। উত্তর আধুনিকতাবাদীরা তাই নারীবাদীতা, যৌনকর্মী, সমকামী, আদিবাসী, কৃষ্ণকায় দলিত, নিম্নবর্ণ মানুষদের সংগ্রাম, পরিবেশকে দূষণ বিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, মনোরোগীদের দাবি-দাওয়া, শিশুদের অধিকার, ছাত্রবিক্ষোভ, জেলখানার সংস্কার, বাঁধবিরোধী আন্দোলন, উভলিঙ্গ মানুষের সমস্যা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুর লড়াই, পথ শিশুদের জীবনবোধ, প্রতিবন্ধিদের বাঁচার স্বপ্ন, ভিক্ষুকদের ভিক্ষার যৌক্তিক দর্শনকে বিশ্বের মূল সমস্যা বলে মনে করেন। বিজ্ঞানবাদেও উত্তর আধুনিকতাবাদের এ সমস্যাকে সমস্যাই মনে করা হয় এবং কবিতায় তার চর্চা করে জনগণচেতনাকে এগিয়ে নিয়ে বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি করতে চায়। ক্ষমতার ইন্দ্রজালকে উত্তর আধুনিক মতাদর্শ, রাষ্ট্রক্ষমতার চেয়েও যেভাবে বড়ো করে দেখা হয় বিজ্ঞানবাদেও তার বাস্তবতা সেভাবেই চিহ্নিত হয় বলে বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের মধ্যদিয়ে তা অপনোদন করতে চেষ্টা করা হয়। একজন ক্ষুধার্ত মানুষকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাবার চেয়ে তার পেটে ভাত দিতে হয়। পেটে ভাত দিলে সঙ্গীত তত্ত্ব তার নিকট বলতে হয় না। সে নিজ থেকেই সঙ্গীত যেমন শুনবে তেমনি চাকা আবিষ্কারের মধ্যদিয়ে যে বিপ্লবের সূত্রপাত তাকে সভ্যতার অগ্রগতিতে আধুনিক ভাবতে বাধা থাকে না। এখানেই বিজ্ঞানের প্রয়োজনীতা অনস্বীকার্য। জাতিকে বিজ্ঞানমনস্ক করতে সক্ষম হলে শিল্প-সাহিত্যও সংস্কৃতিতে তার ছাপ পড়বে, পড়বেই। জীবন যখন বিজ্ঞানতত্ত্বে আবর্তিত হয় শিল্পতত্ত্বে তখন বিজ্ঞানেরই আবহ থাকে। করোনাকালে মানুষ এখন বিজ্ঞানে মুক্তি খোঁজে নিয়েছে তখন বিজ্ঞানই শিল্পতত্ত্ব বা জীবনতত্ত্বের আরেক নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
ঠিক একইভাবে রাষ্ট্রতত্ত্বে যখন পরিবর্তন আসবে জীবনতত্ত্বে তার প্রভাব পড়বেই। তাই রাষ্ট্রীয় ও আর্দশিক ভাবে যখন মানুষের সার্বিক মুক্তির পথ খোঁজা হয় তখন বাগড়া দেয়ার কাজ না করাই শ্রেয়। উত্তরআধুনিক মতাদর্শে যতটুকু না কল্যাণকামী, তারচেয়েও তারা বেশি দেউলিয়া। ভালোবাসা কথার চেয়ে হিংসার কথা তারা বেশি প্রচার করে। সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে এখানেই তাদের মিল বেশি। আবার নিজেদের তারা সমাজতন্ত্রী দাবি করে না, তা অস্বীকারও করে না। মোট কথায় তারা কি করতে চায় আর কী বলতে চায় তা তাদের নিকট পরিষ্কার নয়। এ ধোঁয়াশা ও কুয়াশার মতোই উত্তর আধুনিকতাবাদ। তার মধ্যে বিজ্ঞানবাদ কত উত্তম ও পরিষ্কার একটি আদর্শ ও সংগ্রামের মতাদর্শ, যা গণতন্ত্র, ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের চেয়েও উত্তম এবং মার্কসবাদ, মাওবাদ, লেনিনবাদ, গান্ধিবাদ, মওদুদীবাদ ও মুজিববাদের চেয়ে অনেক প্রাগ্রসর। ক্ষমতার তন্ত্রকারে যতই সর্বত্রব্যাপী থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতার মন্ত্রজালকে অস্বীকার করে না বিজ্ঞানবাদ,। কী প্রক্রিয়ায় ধর্মবাদীদের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রিকরণ করা যায় তা নিয়ে ভাবে বিজ্ঞানবাদ। এখানে উত্তরআধুনিকতাবাদীরা আবার নীরব। পুঁজিবাদের জায়গায় বিজ্ঞানবাদ না মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠা দিতে হবে তা নিয়ে তাদের ভাবনা নেই।
কী প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাকে মানুষের জন্য কেড়ে নেয়া হবে, না আদৌ এ ক্ষমতা কেড়ে নেয়া সঠিক হবে কী-না (?) তার প্রশ্নে তারা মুখ খোলে না। বিদ্যমান সমাজকাঠামো থেকে শোষণ নিপীড়ন দূর করার ক্ষেত্রে তাদের যে নীরবতা, তাতে এ কথা পরিষ্কার যে, কিছু এনজিও মডেলের সংস্কার দিয়ে চলমান অবস্থা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে চায়। তাতে মানুষ তৃপ্ত হয়ে সঠিক শোষণ মুক্তির আন্দোলন থেকে বিরত থাকবে তখন কুট-অপচেষ্টার তাত্ত্বিক হিসেবে উত্তরআধুনিক মতবাদ জন্ম নিয়েছে বলে মনে করা হয়।
বাংলাদেশে উত্তর আধুনিকতা নিয়ে প্রথম সভা-সেমিনার করে মৌলবাদীরা। অজ্ঞেয়বাদিতা ও যুক্তি বিরোধীতার এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে তারা আবিষ্কার করে উত্তরআধুনিকতাকে। ফলে তাদের অন্ধকার ও মধ্যযুগীয় চিন্তার সঙ্গে উত্তরআধুনিকতার মিল পেয়ে তারা বাংলাদেশে তার চর্চা করে। তাদের হাত ধরেই উত্তরআধুনিকতা আজ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত। শ্রেণি সংগ্রামের পথ থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখা কিংবা বিজ্ঞানবাদের স্বপ্ন দেখা থেকে তাদের বের করে আনতে চেয়েছিল তারা। এক সময় এ বাংলাদেশেই জেএমবি’র বাংলা ভাইদের একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিল আবিষ্কারের চেষ্টা করা হতো। উপমহাদেশের সবচেয়ে ঘৃণিত মৌলবাদী মওদুদীকে ‘প্রাচ্যের চিন্তাবাদ’ ভাবা হতো এবং এর গোড়াপত্তন ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে। বাংলা ভাষাকে হিন্দু বাংলা ভেবে মুসলমানি বাংলা প্রচলনের জন্য তারাই এক সময় ষড়যন্ত্র করেছে। এখন আবার এ মৌলবাদীরাই উত্তর-আধুনিকতার চাষ করছে ‘পূর্ববঙ্গের বাংলা’ নামে। যদিও তারা জানে কলকাতার বাংলা থেকে ঢাকার বাংলার আদল অনেকটা ভিন্ন। ভাষা কিছু দূর দূর গিয়ে তাদের বাণী এমনিতেই পাল্টে ফেলে। সেখানে পূর্ববঙ্গের বাংলা আর কলকাতার বাংলা নামে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন নেই। তা বাণীর প্রবাহমানিকতায় এমনিতেই পরিপুষ্ঠ। বাংলাদেশের উত্তরআধুনিকরা মার্কিন, ভারত ও ইসরায়েলকে অপশক্তি ঘোষণা দিয়ে তাদের ছোবল থেকে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য তখন যে কথাগুলো বলে তা খালেদা-নিজামী জোট ও ঐক্যবদ্ধভাবে বলেছিল। বরং বাংলাদেশের জন্য দিনে দিনে চীন ও মায়ানমার যেভাবে অপশক্তিতে পরিণত হচ্ছে তার দিকে উত্তর আধুনিকরা বে-খেয়াল। তাতে বোঝা যায়, ‘উত্তরআধুনিকরা জ্ঞানের দিক থেকে অন্ধ ও তত্ত্বের দিক থেকে বিভ্রান্ত। আর তথ্যের দিক থেকে তারা ভাইরাস আক্রান্ত।’
উত্তরআধুনিকতা বাংলাদেশে মৌলবাদ কবলিত, তার আরেকটি উদাহরণ দৈনিক ইনকিলাব নিয়ন্ত্রিত ‘নতুনধারা’র প্রবর্তন। একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর প্রচেষ্টা এর স্বপক্ষে কর্মরত। ঢাকা থেকে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে স্টুডেন্টওয়েজ বের করে ‘উত্তরআধুনিক কবিতা’ সংকলন। ঢাকার স্বরবৃত্ত প্রকাশন ‘উত্তরআধুনিক : একটি দূরপাল্লার সাক্ষাতকার প্রকাশ করে এরই ধারাবাহিকতায়। তাদের কথা হচ্ছে প্রমিত বাংলা এক সময় ভেঙে পড়বে এবং এর সঙ্গে বহুভাষা (না বহু আঞ্চলিক ভাষা) যুক্ত হয়ে নতুন ভাষা তৈরি করবে। তাই তারা চায় কবিতায় ২৫-৩০ ভাগ আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ। তাকেই তারা উত্তর আধুনিক ধরে নিয়ে বলছে একেক দেশে উত্তরআধুনিক একেক ধরনের হবে। তার মানে তারা উত্তর আধুনিকতাই বুঝতে পারে নাই।
আধুনিকতার প্রাসঙ্গিকতা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে আলোচিত হতে থাকে। ‘ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে এবং তার জায়গায় মানুষকে দাঁড়াতে হবে, অতি মানুষ’ এ স্লোগান নিয়ে নিৎসে প্রথম অতিমানবের ধারণা দেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর নায়ক হিটলার ও মুসোলিনির দুর্বৃত্তায়নের ফলে লেনিন ও মাও সেতুংয়ের নায়কত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তখন বলা হয় নায়ক নয়, সমষ্টিগত আন্দোলনের মাধ্যমে নায়কের জায়গা পূরণ করা হবে। শিল্প বিপ্লবের ফলে বাণিজ্যিক উৎকর্ষতা এবং পুঁজিবাদের দাসত্ব থেকে শুরু হয় ভোগবাদী কবিতা। আধুনিক কবিতা যখন ভোগবাদীতায় গা ভাসিয়ে দেয় তখন উত্তরআধুনিকতার নামে ধর্মীয় মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সবকিছু ভেঙে রিফর্ম কি, তা কীভাবে হবে তার সঠিক কোনো নির্দেশনা নেই- এইতো উত্তরআধুনিকতা। যদি আমি বুঝে থাকি তবে উত্তরআধুনিকতা তাই। এটা ভারতবর্ষীয় প্রেক্ষাপটে বেশি। ইউরোপে নতুন দার্শনিকতত্ত্ব এসেছে মানুষের বিচ্ছিন্নতাকে প্রচার করতে গিয়ে। তাদের কথায় রেনেসাসঁ ও আধুনিকতার মিলনে মানুষকে নায়ক করে আবারো মানবতাবাদের কথা বলা উত্তরআধুনিকতা। ব্যক্তির স্বাধীনতাকে সামনে নিয়ে আসার চেয়ে উত্তরআধুনিকতার ইতিবাচক কোনো দিক আমি খুঁজে পাইনা;
উত্তরআধুনিকরা সংগঠন চান না। সংগঠনকে তারা ব্যক্তির জন্য কারাগার মনে করেন। অথচ পুঁজিবাদকে হটাতে হলে শ্রেণিচেতনাকে জাগাতে হবে। মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালে বৃহৎ লড়াই শুরু হয়। সংগঠন গঠিত হয় লড়াইকে কেন্দ্র করে জাতীয় সংগ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক সংগ্রামে বৃহৎ আকার লাভ করবে। কিন্তু উত্তরআধুনিকরা সংগঠনে বিশ্বাসী নয়! তবে দাঁড়াচ্ছে কী? নৈরাজ্য। মানে মানুষের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে সে আগুনে কাউকে পোড়াতে দেয়া হলো না। মানে দহন দিয়ে আদমকে জ্বালিয়ে ছাই ভস্ম করে দেয়া। অর্থাৎ সভ্যতাকে ধ্বংস করার চক্রান্ত উত্তরআধুনিকতা।
এক্ষেত্রে জাকির তালুকদার সম্পাদিত পূর্বোল্লেখিত ‘প্রতিপাঠ উত্তর আধুনিকতা’ থেকে আরো কিছু প্রমাণ আমার বক্তব্যের স্বপক্ষে গ্রহণ করতে পারি। যেমন- ‘উত্তরআধুনিকতা আসলে উদারনীতিরই সর্বসাম্প্রতিক ও উগ্ররূপ। উদারনীতি ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব দেয়। উত্তরআধুনিকেরা সেই গুরুত্বকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়ে স্বাধীনতার ব্যাপারে প্রায় শুচিবায়ুগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা সমাজ, রাষ্ট্র, সংগঠন এসবের কাঠামোতেই অনাস্থা প্রকাশ করেন; মনে করেন কাঠামো মানেই আধিপত্য। সমাজতন্ত্রীরা কাঠামোকে মানবিক ও সামাজিক করতে চান, নৈরাজ্যবাদীদের মতো তাকে উড়িয়ে দিতে হবে এমনটা ভাবেন না।’ (উত্তর আধুনিকতার প্রাসঙ্গিকতা/সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, পৃষ্ঠা ২২-২৩)।
বাংলাদেশে কেনো ইসলামি মৌলবাদীরা উত্তরআধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে তার কারণ এমনও হতে পারে উত্তর আধুনিকদের মূল পূর্বসূরিরা হচ্ছেন ফরাসি দেশের অস্তিত্ববাদীরা। তারা মানুষের স্থায়ী সত্তার অস্তিত্বের উপর গুরুত্ব দিতেন, নাৎসিদের বিরুদ্ধে তারা কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনো ছদ্মবেশে লড়াইয়ে নেমেছেন, ষাটের দশকের স্যুরিয়ালিজম, দাদাইজম, কিউবিজম এর উপর থেকে ধুলো সরিয়ে দেখা গেল সোনার চেয়ে পিতল বেশি। উত্তরাআধুনিকতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকেরও ও মূল্যায়ন তাই। তিনি আরো লেখেন-
‘…উত্তরআধুনিকতা এমন জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে, যেখানে কোনো ক্ষেত্রে ইভ্যালুয়েশন বলে কিছু থাকছে না। সাহিত্যের ক্ষেত্রে উৎকর্ষ-অনুৎকর্ষ, ভালোমন্দ বলে কিছু থাকছে না। কি শিল্প, কি সাহিত্য, সম্পূর্ণটা চলে যাচ্ছে পাঠকের দিকে। ফলে উত্তর আধুনিকতার দিকে তাকালে শিল্প-সাহিত্যের আলোচনা-সমালোচনা, উৎকর্ষ- অপকর্ষের চিন্তাটাকেই তুলে দিয়ে হয়।’ (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-৩২)।
তিনি আরো লেখেন-
‘….সব মিলিয়ে যেটা দাঁড়াচ্ছে এর মাধ্যমে অবয়ব পেযে যাচ্ছে একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীলতা’। (প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-৩৩)।
মজার ব্যাপার হলো-কলোনিয়াল কাব্যধারায় যেখানে আমরা ছিলাম আবদ্ধ চিন্তায়, সেখানে পোস্টকলোনিয়াল ভাবধারায় যখন বিশ্বায়নের নামে গোটা বিশ্বকে সাম্রাজ্যবাদীরা একই কলোনিতে নিয়ে এসেছে তখন পোস্টকলোনিয়াল কাব্যধারার কথা আলোচিত হচ্ছে। এটা সাম্রাজ্যবাদের দালালি স্বরূপ। একইভাবে তখন আর নিজস্ব অর্থ ও নিজস্ব সত্তা বলে কোনো কিছু থাকে না। এর সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি, বিশ্বায়ন এবং পোস্টকলোনিয়াল কাব্যচেতনার সঙ্গে হুবহু মিল লক্ষ্যণীয়। গোটা বিশ্বকে একটি বাজার সেটা সম্পদে হোক আর সাহিত্যে হোক-তা সাম্রাজ্যবাদীদের অনুকূলে মাত্র। ফলে পোস্টমডার্নিজম ও পোস্টকলোনিয়াল চিন্তা থেকে সাইন্টিজম পোয়েট্রি অনেক বেশি কল্যাণকর ও সর্বজনীন। বিজ্ঞানকাব্যচিন্তায় কোনো মনোপলি বা একচেটিয়া ভাবনা নেই, আছে কেমন সবার জন্য মঙ্গলচিন্তা বিজ্ঞানবাদের অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিপ্লবতত্ত্ব সহজ ও সাবলীল সম্পদের ত্রিমুখি বণ্টন। কোনো ফ্রেমে আটকে পড়ার কিছু এখানে নেই। বিজ্ঞান যেমন বলে না যে, এযাবৎকাল আবিষ্কৃত ১০৫ মৌলিক পদার্থের বাইরে আর কোনো মৌলিক পদার্থের আবিষ্কার হবে না। তেমনি বিজ্ঞানবাদও বলে না যে, আমাদের বিপ্লব কেবলমাত্র জনগণের অথবা সরকারের অথবা পুঁজিপতির জন্য। বিজ্ঞানবাদ বলছে বিপ্লব আমাদের সবার জন্য। বিপ্লবে সবাই অংশ পাবে। কল্যাণমুখিতায় এগিয়ে যাবে তখন দেশ। কবিতা মানুষকে বিজ্ঞানসচেতন করবে, বিজ্ঞানমূলক জাতিও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। ক্ষমতা কাঠামোয় সবার অংশ থাকার নাম বিজ্ঞানবাদ।
পোস্টমডার্নিজম বা উত্তরআধুনিকতা নিয়ে সবচেয়ে জড়ো বিড়ম্বনা হলো- এর সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। একজনের সঙ্গে অন্যজনের মতের বৈপরীত্য মেরু প্রতিম, এসব বিভ্রান্তির জন্যেই পোস্টমডার্নিজম বা উত্তরআধুনিকতা আজ পরিচিতির শীর্ষে। কিন্তু তার একক এবং স্পষ্ট কোনো ইমেজ না থাকাতে তা ফলহীন বৃক্ষ নামে নিস্ফলা হয়ে থাকবে। ধর্মীয় মৌলবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বাইরেও উত্তর আধুনিকতাকে বুর্জোয়াদের দার্শনিক প্রয়াসের সমকক্ষ ভাবা হয়। যেমন-
‘…বিপ্লবকামী শোষিত মানুষের নিরস্ত্র করার লক্ষ্যেই নিয়োজিত হয়েছে বুর্জোয়াদের সমস্ত দার্শনিক প্রয়াস। সেই প্রয়াসেরই সাম্প্রতিক ফসল পোস্টমডার্নিজম নামক বহুরূপী তত্ত্বটি। আর এ তত্ত্ব সবচেয়ে তেজি বাজার পেয়ে গেছে তথাকথিত মুক্তবাজারের রমরমার যুগে- অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর। বহুরূপিতা সত্ত্বেও পোস্টমডার্নিজমের সর্বাঙ্গে ব্যপ্ত হয়ে আছে ডায়ালেকটিক্যাল মেটিরিয়ালিজমকে হেয় করার মতলব। এরকম ছিল মার্কসের কালের সকল বুর্জোয়া দর্শনেরই। ওরকম সকল দর্শনই নতুন পোশাক পরিয়ে প্রো-হেগেলীয় ভাববাদের আশ্রয় নিয়েছে, অথবা আনকোরা যান্ত্রিক বাস্তবাদকে আঁকড়ে ধরেছে। কখনো- বা এই দুইয়ের জগাখিচুরি বানিয়েছে, নানা রকম ধুম্রজালের সৃষ্টি করেছে। এরকম সব বুর্জোয়া দর্শনই আসলে বিপ্লব-বিরোধিতা বা প্রতিবিপ্লবের দর্শন’। প্র্যাগমাটিজম থেকে পোস্টমডার্নিজম ডায়ালেকটিকের আলোকে/যতীন সরকার। প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা-৩৭) বলা হয় প্র্যাগমাটিজম-নিও-প্র্যাগমাটিজম-এর পথ বেয়ে এসেছে পোস্টমডার্নিজম ও পোসটকলোনিয়ালিজম। থিয়োরি কাঠামোর বদলে প্রাকটিস করাকে গ্রিক ভাষায় প্র্যাগমাটিক ও প্র্যাগমাটিজম বলে। গ্রিক শব্দ প্র্যাগমাটোজ যা ডিড (deed) বা কাজ অর্থে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলা পরিভাষায় ‘প্রয়োগবাদ’ বলা যেতে পারে। এমন যুক্তি দিয়ে ঈশ্বর প্রমাণ করা যায় না। বিশ্বাস দিয়ে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করা হয়। তবেই যারা ঈশ্বর বিশ্বাস করে তাদের নিকট ঈশ্বরের সত্য। তাহলে এখানে মডার্নিজম মানুষকে পেছনেই পথ দেখাচ্ছে। তাই সামনে পথ দেখানোর জন্য সাইন্টিজম বা বিজ্ঞানবাদের বিকল্প নেই। মডার্নিজম মানে ধর্মীয় মৌলবাদ করে নিতে আর বাধা থাকে না। এ দর্শনের মূল প্রবক্তা উইলিয়াম জেমস্। মহামতি লেনিনের ‘মেটিরিয়াজিম অ্যান্ড এম্পিরিও ক্রিটিসিজম’ বইয়ের প্রকাশ কালের কাছাকাছি সময়ে ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম জেম্স এর ‘প্র্যাগমাটিজম’ বইটি প্রকাশ পায়। সেখান থেকে বিজ্ঞান যুগে এসে পোস্টমডার্নিজম ও পোস্টকলোনিয়ালিজম-এর বিজ্ঞান দুঃখজনকই নয়, কলিকালের কালিদাসকে গাধার পিঠে উল্টো বসিয়ে শহর থেকে বের করে দেয়ারই নামান্তর। উইলিয়াম জেম্স এর অনুসারী সি.এম. পার্স এবং ডিউই প্র্যাগমাটিজমকে শক্তপোক্ত করে তুলতে কাজ করেন পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের চিন্তার জগতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আধিপত্য বিস্তার করতে করতে ধর্মীয় রহস্যবাদকে জাতীয় সংস্কৃতির অংশ করে গড়ে তোলে। ফলে, রজনীশদের মতো ভারতীয় ধর্মগুরু ও কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের প্রচার করা মূল স্রোতে মিশে যেতে বেগ পান না।
তাই সবাই যে জেনে বুঝে করছে তা নয়, বরং সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যালোচনায় আধুনিক, উত্তর আধুনিক, উত্তর-উপনিবেশিক এ শব্দগুলো আজকাল খৈ এর ফোঁটাটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। বরং ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আধুনিকতার ব্যাখ্যায় যা বলেছিলেন বিজ্ঞানযুগে এসে তাকেই অবলম্বন করে এগোনো যায়। তিনি বলেছিলেন-‘…আমাকে যদি জিজ্ঞাসা কর বিশুদ্ধ আধুনিকতাটা কী, তাহলে আমি বলব, বিশ্বকে ব্যক্তিগত আসক্তভাবে না দেখে বিশ্বকে নির্বিকার তদগতভাবে দেখা। এই দেখাটা উজ্জ্বল, বিশুদ্ধ; এই মোহমুক্ত দেখাতেই খাঁটি আনন্দ। আধুনিক বিজ্ঞান যে নিরাসক্ত চিত্তে বাস্তবকে বিশ্লেষণ করে আধুনিক কাব্য সেই নিরসক্ত চিত্তে বিশ্বকে সমগ্র দৃষ্টিতে দেখবে, এইটেই শাশ্বতভাবে আধুনিক।’ (‘কালের যাত্রা ধ্বনি’ সনৎকুমার সাহা, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৪৭)। তাহলে বিজ্ঞানযুগে উত্তর আধুনিকতা না হয়ে বিজ্ঞানবাদই হবে। এটা না হওয়াই বরং প্রতিক্রিয়াশীলতা।
বিজ্ঞানযুগের শিল্প সাহিত্যের চেহারা তাহলে কেমন হবে? কেমন হতে পারে এ সময়ের শিল্পসাহিত্য কিংবা বিজ্ঞানতত্ত্বের আলোকে আধুনিক থেকে এগিয়ে উত্তরআধুনিক কিংবা উত্তরঔপনিবেশিক সাহিত্য যেমন হতে পারে? ভাবতে হবে। জগৎ সম্পর্কে বুদ্ধি ও যুক্তির আলোকে আমাদের সঠিক ধারণা যদি দর্শন হয় তবে জগৎ সম্পর্কে বিজ্ঞানের ৪টি মৌলিক শাখা থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত সত্যের নাম বিজ্ঞানতত্ত্ব। বিজ্ঞানতত্ত্ব বিকশিত হবার পর দর্শন অপ্রয়োজনীয়। জগৎ সম্পর্কে আমাদের সঠিক ধারণাকে দর্শন হিসেবে গ্রহণ করার পর যুক্তি ও বুদ্ধির আলোকে বা আধুনিক মানস দাঁড়িয়াছিল তাকে অজ্ঞেয়বাদ হিসেবে আমরা দেখতে পাই। বিজ্ঞান এসে অজ্ঞেয়বাদকে দূরীভূত করে পরীক্ষালব্ধ তথ্য ও তত্ত্বে পদ্ধতিগত অগ্রগতিতে নতুন জ্ঞানদান করে, যা বিজ্ঞানবাদ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
ছন্দবিদ্যা
ছন্দ কাকে বলে এ প্রশ্ন নতুন নয়। ছন্দের ধরণ, কী তাদের নাম, এ নিয়ে অনেকেই লিখছেন এবং আগামীতেও লিখেবেন- এটা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু তারা সকলেই সংস্কৃত ছন্দের বারান্দায় ঘুরাঘুরি করে ছন্দবিদ্যা জাহির করছেন- এটাতো মিথ্যে নয়। তাই আমার এ অংশের মূল বক্তব্য হচ্ছে কবির বিশেষত্ব অনুযায়ী তার লেখার ধরন হবে উন্মুক্ত ছন্দে। খুব সহজে ও সাবলীল ভাবে যে কবিতা লিখতে হয় এবং পড়া যায়, তাই আমাদের জন্য হৃদয়গ্রাহী। সেখানে যেহেতু বিজ্ঞান থাকবে অতএব সহজবোধ্য অনুধাবনে এবং বর্ণিত জ্ঞানে লেখা কবিতাই সাবলীল ছন্দের কবিতা।
কবিতার ছন্দ বললে তা হবে দোলায়িত আবহ। হাতের আঙ্গুলে অক্ষর গণনা, মাত্রা মিলানো কিংবা সরের মিল খোঁজার এখন আর প্রয়োজন নেই। দাড়ি, কমা ও যতির ব্যবহারে একই বাক্যে অর্থ প্রকাশক এবং পাঠে জড়তাহীন তাই সাবলীল ছন্দের কবিতা।
হ্যাঁ, তবে একটি কথা বলা হয়, আপনি ছন্দ ভাঙবেন, ছন্দকে জেনেইতো। আমরা তাতে বিস্মিত হই না। কোনো কিছু জানতো বাধা নেই। এটাকে আমরা ছন্দের মধ্যেই ছন্দমুক্তি হিসেবে দেখে থাকি।
ছন্দবিদ্যের এ আলোচনায় আমরা তাই বলতে চাই, ছন্দের মারপ্যাচে আটকে না থেকে ভাব, ভাষা, বাণীতে এবং উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পে বিজ্ঞান রেখে কবিতা লিখুন। দেখবেন জনস্বার্থে কবিতা গুরুত্বপূর্ণ হবে। কবিতাকে একটু সাবলীল করুন, দেখবেন কবিতার গ্রহণযোগ্যতা আবার ফিরে আসছে। কবিতা বর্জিত হচ্ছে এ সমাজে। সাবলীল ছন্দের বিজ্ঞান কবিতা তাই আগামী দিনের সোনালী বাতায়নে মুচকি হাসছে।
কবিতাকে সুরমুক্ত করেইতো আধুনিক কবিতা লেখা হয়েছে। এসেছে আধুনিক ছন্দ। রবীন্দ্রনাথ মুক্তক ছন্দ উপহার দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানযুগে আমি সাবলীল ছন্দের কথা বলছি। আসুন সে কথাগুলো একে একে জেনে নেই।
দান্তের কথা, ‘সুর বসানো কথাই হলো কবিতা’র কথা। তা মনে করিয়ে দিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ। গীতি কবিতা বা সুরমুক্ত কবিতাই আধুনিক কবিতা এটা আমরা জানি। মধ্যযুগের কবিতা তো গান। চর্যাপদ থেকে যার শুরু, মাঝখানে মাইকের থেকে হীরা লাল বাদ দিলেই রবীন্দ্রনাথ আবার গীতি কবিতায় মগ্ন হলেও তার শেকল আবার তিনিই ছিঁড়েছেন।
ছন্দের মারপ্যাচ থেকে মুক্ত হয়ে বাণীর সাবলীলতা আনতে পারলেই কণ্ঠে আসবে মাধুর্য এ ভাবনা আমার।
মধুসূদনদত্তের অমিত্রাক্ষর ছন্দ এক সময় সাহিত্যে ঝড় তুললেও এখন তার প্রবাহমানতা নেই। সংস্কৃত ছন্দকে সুধীন্দ্রনাথ এবং বুদ্ধদেব বসু পুনরায় প্রতিষ্ঠা দিলেন বাংলা কাব্যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলাকায় এসে আবারো সংস্কৃত ছন্দ থেকে কবিতাকে মুক্তি দিলেন।
বিষ্ণু দে কাব্যের ইতিহাসকে টেকনিকের ইতিহাস বলেছেন। শঙ্খ ঘোষ বলেছেন, ‘ছন্দে সমর্পিত শব্দেরই নাম কবিতা’। তাহলে কবিতা আর্ট ও সায়েন্সহীন ক্রাফ্ট হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে কবিতা সাবলীলতা হারায়। মানে ছন্দহীনও হয়। তাহলে আমরা আগেই ছন্দকে দূরে ঠেলে দিতে পারি না কেন (?) পারতে হবে। ভারতচন্দ্র থেকে সত্যেন্দ্রনাথ পর্যন্ত ছন্দের যে অনুসরণ তাতো ছিল সংস্কৃত ছন্দের ধারায় বেঁচে থাকার চেষ্টা। কবিদের এ চেষ্টা ছিল নিজেদের আবারো সর্বশান্ত করা। আমার মতে, বিজ্ঞানহীন কবিতা লিখে নিজেদের মেধার অপচয় করা হচ্ছে। তার ওপর কবিতার ছন্দ ছন্দ করে মাতায়ারা হয়ে পড়া মানে নিজের চারপাশকে বিষিয়ে তোলা।
মন্দাক্রান্তর প্রতি চরণে চারপর্ব আর তার মাত্রাক্রম ৮+৭+৭+৫। এটা ভুল না হলেও কবিতায় এটা কোনোভাবেই মূল বিবেচ্য হতে পারে না। ছন্দ মুক্তির আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে এ বিবেচনা থেকে।
মুক্তক ছন্দ মিশ্র ছন্দ কিনা (?) এবার সে প্রসঙ্গ যা রবীন্দ্র না উল্লেখ করেছেন। তিনি সে ছন্দে অভ্যন্তরীণ মুক্তির আয়োজন করেছিলেন। সেখানে অন্তমিল থাকতেও পারে, নাও পারে। এক কথায় কোনো নীতি থাকবে না তা কথিত বাংলা ফ্রি ভালে। মাত্রা সমতা থাকলেই হবে। পূর্ব নির্দেশের বন্ধন থেকে খোলা প্রজাপতির মতো বেরিয়ে আসার চেষ্টায় উল্লখিত মুক্তির আনন্দ উপভোগ করার ইচ্ছে ছিল রবীন্দ্রনাথের। বাংলা ছন্দকে সেভাবে গড়ার স্বপ্ন তার পূর্ণ হয়নি সত্য। তবে এখন সাবলীল ছন্দের মাধ্যমে সে ইচ্ছেই পূর্ণ হবে।
এ ধারাতেই সমর সেনের হাতে গদ্য ছন্দ সৌন্দর্য খনিতে পরিণত হয়। আমরা দেখি রবীন্দ্রনাথ সমর সেনের গদ্যছন্দ নিয়ে তাই মন্তব্য করেন, ‘গদ্যের রূঢ়তার ভিতর দিয়ে বাক্যের লাবণ্যের প্রকাশ’। বাক্য যদি সম্পূর্ণ হয় এবং সুন্দর অর্থ প্রকাশ করে তবে তা গদ্য ছন্দেও মাধুর্যতা তৈরি করতে পারে।
মুক্তক ছন্দের পর গদ্য ছন্দ আরেকটু খোলামেলা ও বিস্তৃত। বাক্যাংশকে সমান্তরাল হতে হবে- এটাই গদ্যছন্দের ভিত্তি।
বাংলা কাব্যে শ্লথ গতিতে ঋজুতা আনার জন্য মুক্তক ছন্দ থেকে গদ্য ছন্দ এবং সেখান থেকে কৌশলী সাবলীল ছন্দ।
বুদ্ধদেব বসুই সমর সেনকে নিয়মিত বা প্রচলিত ছন্দের ব্যবহার ছেড়ে কবিতা লিখতে বলতেন। এ পর্যন্ত ঠিক বলেছেন শঙ্খঘোষ। গদ্য ছন্দের নির্দিষ্ট কোনো ছাঁচ নেই। তাই কী হবে, কেমন হবে তার ধরণ সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। এখানেই সুবিধা। ভিন্ন ভিন্ন কবির হাতে ভিন্ন ভিন্ন মেজাজ, আঙ্গিক ও ভিন্ন ভিন্ন সুরে লেখা হবে গদ্য ছন্দের কবিতা। সেখানেই কৌশলী হতে পেরেছে সাবলীল ছন্দ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও ‘সন্ধ্যা ও প্রভাত’ ‘সাধারণ মেয়ে’ আর ‘পৃথিবী নামক তিনটি কবিতায় আলাদা আলাদা ভাবে তিনটি গদ্য ছন্দের আদল দিয়েছেন।
হুইটম্যানের গদ্য কবিতা ছিল লাইন ডিঙানো। গদ্য কবিতার দীর্ঘ এমন বাক্যও আমরা দেখেছি ইংরেজি সাহিত্যে। আর যাঁবো-র টানা গদ্যের কবিতার কথা কে না জানে? সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং অরুণ মিত্রের গদ্য ছন্দের বৈচিত্রময়তা কতই না শিল্প উন্মাদ ছিল। প্রত্যেক কবি গদ্য ছন্দের ভাষা তৈরি করবেন নিজের মতো করে এটাই স্বাভাবিক।
এককথায় কবিতা সৃষ্টিতে তার সমস্ত অবয়ব জুড়ে আপনা আপনিই উঠে আসবে তার স্বর, স্ফূর্ত ছন্দ অনুভব হবে তার রক্তে, সাবলীলতার ঢেউ তৈরি হবে তার বাণীতে। এমন অভিজ্ঞতা তৈরি হলেই কবি সফল। ফ্রস্টের মতো এমন অভিজ্ঞতা গদ্যকবিদের হতেই হবে। আমাদের সর্বস্ব ত্যাগী প্রয়াত কবি হানিফ খান রাস্তায় হেটে হেটে গান বাধতেন। তার গানতো কবিতাই। কবিতা পরিষদ থেকে সূত্রাপুরের বাসা কিংবা বিটিভি থেকে সূত্রাপুর বা বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত যেতে না যেতেই তার সৃষ্টি উঠে আসতো প্রকৃতি থেকে।
হুইটম্যান আর যাঁবো-র সঙ্গে যেমন গদ্য কবিতার আলোচনায় গিনসবার্গ আর ফার্লিং গেভির ছন্দরূপ নিয়ে আলোচনা হয়, তেমনি আলোচনা করা যায় সমর সেনের সঙ্গে বুদ্ধদেব বসু আর সঞ্জয় ভট্টাচার্যের গদ্য ছন্দের কবিতা নিয়ে। ক্রিয়াহীন খর্ব বাক্য প্রয়োগের আশ্চর্যজনক রীতি তার ভিন্ন আলোচনা।
কবিতা হলো শব্দের স্বর। সে স্বর যখন সুরেলা হয়ে যায় তখন স্বভাবিক ভাবেই একটি ছন্দে আচ্ছন্ন হন কবি। সে ছন্দই সাবলীল ছন্দ। এর বাইরে কবিকে আর কোনো ছন্দ না শিখলেও চলবে।
Array