ইকবাল আলম
সাঈদ লিটন সমকালের উদীয়মান ও শক্তিমান একজন কবি। ‘শব্দ নাটাই’ নামে তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থ সেই শক্তির স্মারক। অল্প কথার কাব্যগাথায় যিনি অনায়াসে তুলে আনতে পারেন অনন্ত সন্ধানী গ্রামীণ মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন, সমকালীন সংকট ও সাধারণ মানুষের আহাজারি। চিন্তা ও মননে তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ লালন করেন। বিগত সময়ের রাজনৈতিক পঙ্কিলতা যাকে দ্রোহের মিছিলে শামিল করেছে সোচ্চারভাবে। সুকান্তের মতো তার কবিতায়ও উঠে এসেছে সেই শব্দগাথা, ‘কূলের নিশানা নেই উদয়-অন্তে/ সম্মিলিত সুশীল অস্তিত্ব জুড়েও বদের সংবিধান!/ ক্ষুধার্ত পেটের উপর দাঁড়িয়ে আছে/ মেট্রোরেলের স্তম্ভ।’ সাঈদ লিটন বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্রামীণ জনপদে বৃক্ষ সুশীতল পথের ধারে মাচার উপর বসে থাকা সাধারণ্যে অসাধারণ একজন কবির ছবি। গ্রামের সোঁদা মাটির গন্ধে শৈশব ও কৈশোর কাটানো কবি জীবনকে উপলব্ধি করেন এভাবে,’একটি জীর্ণ টাইপ রাইটার;/ধীরে ধীরে অবতরণ করে মানুষের বুকে / … / প্রমত্ত যুবককে হত্যা করে যৌবন /ধীরে ধীরে শিশু হয়-/রাতপেঁচার চোখে সময়ের ঘন্টায়/ শিশুটি মেঘ হয়ে যায়।’
লিটনের সাথে আমার পরিচয় অনলাইন সাহিত্য সংগঠন বলপয়েন্টের মাধ্যমে। ২০২০ সালে বিজয় দিবস উপলক্ষে কবিতা প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম হয়েছিলেন। জানতে পারলাম ঢাকায় থাকলেও তিনি ফেনীর মানুষ। সেই থেকে আমরা বলপয়েন্টে একসাথে কাজ করছি। কবিতা-অন্তপ্রাণ এই মানুষটি ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেন চৈতন্যের ঘরে কাব্য-নিমগ্নতায়। কেন্দ্রের কবি থেকে প্রান্তের কবি পর্যন্ত সবার সাথে তার সুসম্পর্ক কবিতাকে ঘিরে। আড্ডায় মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে জাবরকাটেন কবিতার রসকস। এখনো তিনি কবিতার ছাত্র। নিয়মিত শেখেন গুরুদের পাঠশালায়। কবিতার জন্য প্রয়োজনে বৈরাগ্য সাধনে তার দ্বিধা নেই। তার মতে, ‘কবিতা আমাকে আশ্রয় দিয়েছে,/দিয়েছে শুদ্ধগতি;/ কবিতার প্রেমে আপসে মেনেছি,/ যাপনের যতো ক্ষতি।
তার কবিতার শরীরজুড়ে দেশপ্রেম উথলে পড়ে বারবার। নষ্ট রাজনীতি, ঘুষ দুর্নীতি আর কালোটাকার মহোৎসবের বিরুদ্ধে তিনি লিখেন, ‘বিশাল বাসা মস্ত অফিস-উল্টোপথে টাকার ডাক/ বাসা অফিস এটাই স্বদেশ অন্য সবাই গোল্লা যাক/ দুষ্ট টাকার রুষ্ট পাঠে / মানচিত্রটা নর্দমাতে/ স্বদেশপ্রেম কি জয়-জিন্দাবাদ মাঝে দেখো বেজায় ফাঁক!’/ কর্মজীবন ঢাকা হলেও নাড়ির টানে তিনি ফেনী আসেন প্রায়শ। ঘরের পাশে পাটিপাতা বন, ধান ফসলের মাঠ আর মায়াভরা নিসর্গের টানে জিরিয়ে নেন কিছুদিন। তার কবিতায় সে অনুভূতি উঠে আসে, ‘গাছ বিথীকায় প্রেমসুর বাজে/ মায়ার দ্রৌপদী টানে/ এ মাটির সাথে মন জুটি বাঁধে/ চুপকথা অভিমানে /’ একজন হাসিখুশি সদালাপি ও বন্ধুবৎসল মানুষ লিটন।
অতিথি পরায়ণতা তার নিত্যদিনের স্বভাব। তার ছায়া সুনিবিড় গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন শহুরে কয়েকজন কবি। কবির আন্তরিক অব্যর্থনা ও আথিত্যে মুগ্ধ হয়ে এই লিখিয়ে লিখেছিলেন, ‘অতঃপর আমরা চলে এলাম/ বুকে জমে আছে একটি গ্রাম/ নদী নিসর্গে ঘেরা জলরঙের ছবি/ পিছুডাকে এক কাব্যচাষার ভালোবাসা/ বুক তার জেগেওঠা নবান্নের চর/ শালিকের ঝাঁক খেলেবেড়ানো…’ / ভ্রমণ বিলাস এই কবির অন্যতম শখ। বলপয়েন্টের প্রতিটি আনন্দ ভ্রমণে তিনি সদল বলে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া বই পড়া, লেখালেখি করা, গান শোনা তার শখের মধ্যে অন্যতম।
লিটনের জন্মস্থান ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার উত্তর নেয়াজপুর গ্রামে। ইয়ে করে বিয়ে করা সহধর্মিণী ফেনী শহরের মেয়ে লতিফা আক্তার রুনার সাথে তার সুখের সংসার।ছেলে আহনাফ তাহমিদ পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে, মেয়ে সামিনা তাহসিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনফরমেশন টেকনোলজিতে ও ছোট মেয়ে তাসফিয়া তাহসিন হলি ক্রস কলেজে পড়াশোনা করছে। ৩১ ডিসেম্বর কবির শুভ জন্মদিন। জন্মদিনে কবিকে অরিন্দম শুভেচ্ছা। তার ভাষায় কবিতা, ‘আধ্যাত্মিক অনুভূতির দুর্লভ মুহূর্তের ভাব প্রকাশের শৈল্পিকরূপ হলো কবিতা।’ শেষ করছি কবির লেখা কবিতার ক’টি চরণ দিয়ে, ‘ স্রষ্টা এবং কবিতার জন্য/ খুব আকুল করে আকাশ পানে প্রতীক্ষায় থাকি;/ কখন ফিরবে সানন্দ কবিতা/ ফিরবে কি স্রষ্টার কাঙ্ক্ষিত হাত?/ সবুজ জড়ানো ওহি!/
লেখক : কবি ও সংগঠক ইকবাল আলম
Array