নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলা একাডেমিতে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধন করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘ প্রায় দু’দশকের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটেছে। বায়ান্নের ছাত্রজনতার প্রেরণার পথ ধরে চব্বিশের ছাত্রজনতা বাংলাদেশকে নতুন মুক্তির স্বাদ দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে অমর একুশে বইমেলা ২০২৫ অন্যতর তাৎপর্যে আমাদের কাছে হাজির হয়েছে। আমরা আশা করি বইমেলায় লেখক-প্রকাশক ও পাঠক তাঁদের মেধা ও শ্রমের প্রকৃত প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হবেন এবং তাঁদের উপযুক্ত মূল্যায়ন লাভ করবেন।
তিনি বলেন, একুশ মানে জেগে ওঠা, একুশ মানে অবিরাম সংগ্রাম। একুশের মাঝে আমরা আত্মপরিচয়ের সন্ধান করি। যে কোনো জাতীয় সংকটে আমরা শহিদ মিনারে সমবেত হয়ে অদৃশ্য ঐক্যের সাক্ষাৎ লাভ করি।
শনিবার ১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৫’ উদ্বোধনকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব কথা বলেন। এবারের বইমেলার মূল প্রতিপাদ্য ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান : নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সচিবের রুটিন দায়িত্ব), মোঃ মফিদুর রহমান এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি মোঃ রেজাউল করিম বাদশা। বিশেষ অতিথির বক্তব্য প্রদান করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সভাপতির ভাষণ প্রদান করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, একুশ আমাদের মূল সত্তার পরিচয়। একুশ আমাদের ঐক্যের দৃঢ় বন্ধন। এই বন্ধন ছোট-বড়, যৌক্তিক-অযৌক্তিক, ক্ষণস্থায়ী- দীর্ঘস্থায়ী সব দূরত্বের ঊর্ধ্বে। এজন্য সব ধরনের জাতীয় উৎসবে, সংকটে, দুর্যোগে আমরা শহীদ মিনারে ছুটে যাই। একুশ আমাদের পথ দেখায়। মাত্র ছয় মাস আগে জুলাই গণঅভ্যুত্থান জাতিকে এক ঐতিহাসিক গভীরতায় ঐক্যবদ্ধ করে দিয়েছে। যার কারণে আমরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং মানবিক দিক থেকে বিধ্বস্ত এক দেশকে দ্রুততম গতিতে আবার উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তৈরি করার জন্য প্রস্তুতি নিতে সাহস খুঁজে পেয়েছি।
তিনি বলেন, একুশের টান প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিস্তৃত হয়েছে শুধু তাই নয়, এই-টান গভীরতর হয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। দুঃস্বপ্নের বাংলাদেশকে ছাত্র-জনতা নতুন বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তারা অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। আমাদের তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে তাদের স্বপ্নগুলো, তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো, তাদের দাবিগুলো অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় এঁকে দিয়েছে। আমাদের রাস্তার দেয়াল এখন ঐতিহাসিক দলিলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি, শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবিগুলো যারা মেলায় স্থান করে দিয়েছে। সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে। বইমেলার একাংশে এই তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীদের আঁকা ছবিগুলোর প্রদর্শনী করা গেলে বইমেলায় আসা ক্রেতারা, দর্শকরা উপকৃত হত।
উপদেষ্টা বলেন, বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। ক্রমে ক্রমে এর গুণগত ও আয়োজনগত বিবর্তন হতেই থাকবে। প্রকাশকরা অনেক আয়োজন করেন নিজেদের বইগুলো যথাসময়ে হাজির করার জন্য। গুণগত প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করার জন্য এবং আগ্রহ বাড়ানোর জন্য প্রতিবছর বিষয় ভিত্তিক সেরা লেখক স্বীকৃতির আয়োজন করলে লেখকরা এই স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য এবং সেরা লেখকরা সেরা প্রকাশক পাওয়ার ব্যাপারে সহায়ক হতো। আমি এ প্রস্তাব দিচ্ছি।
স্বাগত ভাষণে অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, জুলাই গণ-অভুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তির পথে বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরু হয়েছে। আমরা একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গণমানুষের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্তর্ভুক্তিমূলক বইমেলা আয়োজনের চেষ্টা করেছি।
মোঃ রেজাউল করিম বাদশা বলেন, বই জাতীয় চেতনার প্রতীক। জাতির মননের যথার্থ বিকাশের জন্য প্রকাশনাকে শিল্প ঘোষণা করা যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রকাশক কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করাও সময়ের দাবি। এবারের বইমেলা সবার অংশগ্রহণে সার্থক ও সফল হবে বলে আশা করি।
মোঃ মফিদুর রহমান, এ বছরের বইমেলা মানে বায়ান্নর চেতনা থেকে চব্বিশের প্রেরণা। জ্ঞানের সূচনা বই আর বইমেলা নতুন বইয়ের বিপুল জোগানদার। বইকে ভিত্তি করে আমরা মুক্ত মানুষের স্বাধীন প্রকাশের উৎসব উদ্যাপন করব।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেন, বাংলা একাডেমি অমর একুশে বইমেলার আয়োজন করে। সাম্প্রতিক সময়ে একাডেমি তরুণ গবেষকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করেছে, লেখক কর্মশালার আয়োজন করেছে। তবে সাম্প্রতিক চিন্তার সঙ্গে একাডেমিকে সংযুক্ত করার জন্য আমাদের সংস্কারমুখী মনোভাব প্রয়োজন, যাতে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সেতুবন্ধ তৈরি হয়।
সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ বছরের বইমেলাও এ চেতনার আলোকে আবর্তিত হবে বলে আশা করা যায়। একশ বছর আগে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের উদ্যোগে যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল তার উত্তরসাধক হিসেবে আজকের তরুণ লেখকদের চিন্তার বদ্ধতা অতিক্রম করে উন্নত মন ও মননের সাধনা করতে হবে।
অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪ প্রদান করা হয়। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা অনুষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকগণের হাতে পুরস্কারের অর্থমূল্যের চেক, ক্রেস্ট ও সম্মাননাপত্র তুলে দেন। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪ পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন কবিতা-মাসুদ খান, নাটক ও নাট্যসাহিত্য-শুভাশিস সিনহা, প্রবন্ধ/গদ্য-সলিমুল্লাহ খান, অনুবাদ-জি এইচ হাবীব, গবেষণা-মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া, বিজ্ঞান-রেজাউর রহমান এবং ফোকলোর- সৈয়দ জামিল আহমেদ।
Array