ভরশ্রাবণে বাঙালি সাধারণত কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। আকাশের দিকে আকুল হয়ে যখন তাকিয়ে থাকে, তখন অপূর্ব শ্রাবণধারা হৃদয়কে ব্যাকুল করে তোলে। মনের ভেতর ঘুরতে থাকে রবি ঠাকুরের হৃদয় হরণ করা শ্রাবণের সংগীত ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে/তোমারি সুরটি আমার মুখের ’পরে, বুকের ’পরে’ সাধারণত এ রকম প্রাকৃতিক পরিবেশে সংবেদনশীল মানুষের পক্ষে প্রকৃতির অনিন্দ্যসুন্দর রূপের প্রভাবের বাইরে যাওয়া খুব কঠিন। কিন্তু এবারের শ্রাবণ, এবারের বর্ষা এই কঠিনকে কোমল করে দিয়ে এক ভিন্ন আবহ নিয়ে এসেছে আমাদের সামনে। আকাশের অপরূপ মন-ভোলানো রূপকে ছাপিয়ে স্বজনদের কান্নার ধ্বনি বৃষ্টির শব্দের মতো বাজছে বাঙালি হৃদয়ের গহিনে।
শুধু শ্রাবণ বলছি কেন, মধ্য আষাঢ় থেকেই আমরা অনেকেই মানসিক এবং শারীরিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। স্বজন, সুজন অনেকেই অদৃশ্য দানবের ছোবলে বিপর্যস্ত। অনেক প্রিয়জন আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। একজন যাওয়ার পর যখন তার শোক কাটানোর চেষ্টা করছি, তখন অন্য কোনো স্বজনের সঙ্গে চিরবিচ্ছেদের সংবাদ পাচ্ছি। এ রকম বর্ষা এর আগে আর কখনো আসেনি আমাদের সুবর্ণ পলির অপরূপ এই দেশে।
মেঘের আড়াল থেকে মেঘনাদ যেমন যুদ্ধ করতেন, অদৃশ্য করোনাভাইরাসও আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, নিষ্ঠুরভাবে তার নিরাকার রূপ নিয়ে। পুরো বিশ্বে ৪২ লাখেরও বেশি মানুষ এখন পর্যন্ত প্রিয়জনদের ছেড়ে চলে গেছে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে, শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে থাকা দেশগুলো মৃত্যু উপত্যকায় রূপ নিয়েছে। তার পরও জীবন থেমে থাকেনি। মানুষ আবার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মানুষ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কভিড-১৯-এর ছোবলে। ধীরে ধীরে তারাও উঠে দাঁড়াচ্ছে। অফিস, আদালত, কলকারখানা, শিক্ষাঙ্গন পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়া হচ্ছে। মানুষ ধীরে ধীরে নিজেদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। তাদের উঠে দাঁড়ানোর এই সময়ে স্বদেশে আমরা করোনাকালের সবচেয়ে বিপর্যয়ের সময় কাটাচ্ছি। তবে এই ভূগ্রামের বাসিন্দা হিসেবে আমরা এই দহনকালেও আশাবাদী যে কিছুদিনের মধ্যে আমরাও উঠে দাঁড়াব। কী করে অন্ধকার ভেদ করে আলোর দিকে পা বাড়াব, তা নিয়ে আলোচনায় আসছি পরে।
মানুষ হিসেবে এ রকম ক্রান্তিকালে আমাদের মন বিষণ্ন হয়ে পড়ে। আবার প্রাকৃতিক নিয়মে এই মানুষকে ভালোবেসেই আমাদের উঠে দাঁড়াতে হয়। আমাদের দেশে যখন শ্রাবণের শুরু থেকে গড়ে দুই শরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে এবং নতুন করে গড়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তখন একদল লোক ভীতি ছড়িয়ে মানুষকে হতাশ করে তাদের মানসিক শক্তিকে দুর্বল করে ফেলছে। আমরা জানি করোনার সঙ্গে লড়তে হলে মানসিক শক্তি খুব প্রয়োজন। এই শক্তিকে দুর্বল করা মানে করোনার সঙ্গে লড়াই শুরুর আগেই পরাজয়কে আহ্বান করা। আমরা জানতাম আমাদের সংক্রমণ বাড়বে। এই সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি রোখার পথ যখন খুঁজে বেড়াচ্ছেন বিশেষজ্ঞ, প্রশাসন এবং নীতিনির্ধারকরা, তখন আমাদের উচিত এই ক্রান্তিকালে সবার সুসমন্বিত প্রচেষ্টা। আমরা জানি, করোনা মোকাবেলায় আমাদের নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অনেক ত্রুটি রয়েছে; কিন্তু সংক্রমণ ও মৃত্যু যখন চূড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন আমাদের উচিত সংহতি, দেশপ্রেম এবং নিবেদনের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের। অগ্নিকাণ্ড ঘটলে ফায়ার ফাইটারদের সহযোগিতা করতে হয়। আগুন নিভে যাওয়ার পর ত্রুটি অনুসন্ধান করতে হয়, এই সাধারণ জ্ঞানটি আমাদের অনেকের মধ্যেই লোপ পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি একটি নির্দিষ্ট কারণের ফল নয়। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিকে মাল্টিফ্যাক্টরিয়াল বা বহুমুখী কারণের ফল বলে জাতীয় কারিগরি কমিটি মনে করে। অনেক কারণের একটি কারণ হিসেবে ঈদুল আজহার কথা বিবেচনা করে ১৫ জুলাই ভোর থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত আট দিন বিধি-নিষেধ শিথিল করাকে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিধি-নিষেধ শিথিল করায়ও সংক্রমণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেত না, যদি না বানের জলের মতো ছোটা মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরমুখী এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকামুখী হওয়ার চেষ্টা করত। কারিগরি কমিটির সদস্যদের এ বিষয়ে মতামতটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, ‘যদি এমন হতো, আমরা শিথিল করলাম, কিন্তু শতভাগ মানুষ মুখে মাস্ক পরছে, তাহলে কি আজ এ রকম হতো?…হতো না।’ এ ছাড়া এখন যত সংক্রমণ হচ্ছে তার মধ্যে ৮০ শতাংশই ডেল্টা ভেরিয়েন্ট। এই ভেরিয়েন্ট আগের যেকোনো ভেরিয়েন্টের চেয়ে প্রায় দেড় গুণের বেশি মানুষকে সংক্রমিত করছে আর এসব মিলিয়েই আজকের এই সাময়িক বিপন্ন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন হলো, আমরা ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ও মৃত্যু দেখে কি থমকে দাঁড়াব, ভীত হব এবং ভীতি ছড়াব, নাকি আমরা আমাদের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও বাস্তবতা বিবেচনা করে প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় সর্বোচ্চ দেশপ্রেম ও নিবেদন নিয়ে এগিয়ে আসব। জাতীয় কারিগরি কমিটির মতামত অনুযায়ী সংক্রমণ ও মৃত্যু চূড়ার দিকে এগিয়ে যাবে আরো দু-তিন সপ্তাহ, তারপর পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সম্প্রতি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি খুব সহজ ভাষায় একটি বাস্তব বিষয়ের অবতারণা করেছেন। ২৩ জুলাই থেকে শুরু হওয়া কঠোর লকডাউনের পঞ্চম দিনে সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেন, আগামী ৫ আগস্ট অর্থাৎ লকডাউন শেষ হওয়ার সর্বশেষ দিনের পর লকডাউন তুলে নেওয়া হবে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা তো এভাবে বাঁচতে পারব না। আমাদের মাস্ক পরতে হবে, কাজও করতে হবে। আমাদের টিকার সংকট কেটে গেছে। এখন সবাইকে টিকার আওতায় আনা হবে।’ আমাদের মাস্ক পরতে হবে, কাজও করতে হবে। এখানে মাস্ক পরতে হবে কথাটি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে অর্থে তিনি ব্যবহার করেছেন। আশার বিষয় মৃত্যু ও শনাক্তের হার বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে সরকার তা রোধ করার জন্য কার্যকরী ও সাহসী পদক্ষেপ নেওয়াও শুরু করেছে। ক্রান্তিকালে আলোর রেখার মতো এ মুহূর্তে আমাদের হাতেও সরবরাহ ধারায় যথেষ্ট পরিমাণ টিকা আছে বলে আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে জানতে পেরেছি। গত দুই মাসে বাংলাদেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উপহার হিসেবে, চীনের কাছ থেকে ক্রয়সূত্রে, কোভ্যাক্সের মাধ্যমে এবং জাপানসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে টিকা পেয়েছে; আরো টিকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে।
সম্প্রতি সরকার একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে আর সেটি হলো, ইউনিয়ন পর্যায় থেকে কভিড-১৯-এর টিকা প্রদান করা, যা এরই মধ্যে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরুও করা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতিকে যত সহজ করা যায়, তত সহজ করা হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র দেখালেই টিকাকেন্দ্রে রেজিস্ট্রেশন করানো হচ্ছে। একটি গণমুখী সরকারের পক্ষ থেকে টিকা কার্যক্রমকে গতি দেওয়ার জন্য যত সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, সরকার সব পদক্ষেপই গ্রহণ করছে। ইউনিয়ন পর্যায়, ওয়ার্ড পর্যায় থেকে টিকাদানকে কেন যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলা হচ্ছে? কারণ বিশ্বজুড়ে টিকাদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির মডেল অনুসরণ করে বাংলাদেশের ওয়ার্ড পর্যায় থেকে সূচিত কভিড ভ্যাকসিন কর্মসূচি দ্রুত সাফল্য পাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির সাফল্য এতই অনুসরণীয় যে এর কারণে বাংলাদেশ পেয়েছে অসংখ্য বৈশ্বিক স্বীকৃতি। এই কর্মসূচির ফলেই দেশে মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোর পাশাপাশি পঙ্গুত্ব রোধ করা সম্ভব হয়েছে। টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার দিয়েছে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এবং ইমিউনাইজেশন। আমাদের অভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ট একটি পরীক্ষিত মডেল ব্যবহার করে সফলতার দ্বারে পৌঁছে যাওয়ার আশা করা তাই নিশ্চয় কোনো আকাশকুসুম ভাবনা হতে পারে না।
বৈশ্বিক অতিমারির নিষ্ঠুর ছোবলকে প্রতিহত করতে হলে দোষারোপ, বিভেদের রাজনীতি পরিহার করে জাতীয় সংহতির সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করতে হবে। গণতান্ত্রিক সমাজে দুর্যোগ, মহামারিকালে মানুষের পাশে না দাঁড়ালে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর। জাতির এই বিপন্নকালে আমাদের বিরোধী দলগুলোর উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা জনগণের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আহ্বান জানানো হচ্ছে দল-মত-নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে। যাঁরা এগিয়ে আসবেন তাঁরা জনগণের মনে ঠাঁই নেওয়ার এক অপার সুযোগ পাবেন আর যাঁরা দোষারোপ, কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত থাকবেন, তাঁরা চিরদিনের জন্য মানুষের আস্থা, ভালোবাসা ও সমর্থন হারাবেন। জাতির এই দুর্যোগকালে কি বোধোদয় হবে আমাদের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর। সালতামামির মতো জনগণের মূল্যায়নের খাতায় কিন্তু সবার ভূমিকাই নথিবদ্ধ থাকবে।
লেখক : উন্নয়ন গবেষক ও কলাম লেখক
Array