প্রশিক্ষণে আটকে আছে গ্রামে গণটিকাদান কার্যক্রম। হাতে পর্যাপ্ত টিকা থাকার পরও কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় এ সংক্রান্ত কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। টিকা দেওয়ার সঙ্গে জড়িত ইপিআই কর্মীদের প্রশিক্ষণ এখনো চলছে। দেরির কারণে তৃণমূলসহ দেশব্যাপী করোনার সংক্রমণ রোধে গৃহীত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের বিস্তার বাড়ছে। এদিকে সারা দেশে মানুষকে টিকা দেওয়া হবে-এটা জানার পরও সংশ্লিষ্ট কর্মীদের প্রশিক্ষণ শেষ না হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। গণটিকা শুরুর মাধ্যমে হাসপাতাল থেকে টিকাদান কেন্দ্র সরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
দেশের মহামারির ভয়াবহ সংক্রমণ হ্রাসে সরকার সারা দেশে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এক সপ্তাহে এক কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনার পরিকল্পনা করেছে। এই পরিকল্পনার অধীনে ১৫ হাজার ২৮৭টি ওয়ার্ডে ৬৯ হাজার ৩১৮ সেশনে এক কোটি ৩৪ লাখ ৪২ হাজার টিকাদানের সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমানে সক্ষমতা আছে তিন লাখ ডোজের; কিন্তু দেওয়া হচ্ছে ৫০ হাজার। এ অবস্থায় এক সপ্তাহে এক কোটি টিকা দেওয়া কতটা সম্ভব, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, ইপিআই কর্মীদের প্রশিক্ষণ শেষ না হওয়ায় ব্যাপক হারে টিকা দেওয়ায় দেরি হচ্ছে। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া এই কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজ-কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক আর ঢাকার ভেতরে মেডিকেল কলেজগুলোয় টিকাকেন্দ্র করতে চাই।
তিনি বলেন কলেজের জায়গা বড়, শিক্ষার্থীরাও নেই, সেখানে মাল্টিপল বুথ করে টিকা দিতে চাই। আর গ্রামাঞ্চলে টিকাদানের বিষয়ে ইতোমধ্যে মাইক্রো প্ল্যান হয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষ হলেই ৭ আগস্ট থেকে টিকা দেওয়া শুরু হবে। তিনি বলেন, দেশে করোনার টিকাদান কেন্দ্র অচিরেই আরও বাড়বে। সিটি করপোরেশন এবং গ্রামের ওয়ার্ড পর্যায়ে টিকা দেওয়া শুরু হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা চাচ্ছি হাসপাতাল থেকে টিকা কেন্দ্র বের করে আনতে। হাসপাতালগুলোয় টিকাদান কেন্দ্র করার কারণ ছিল টিকা নেওয়ার পর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কি না, যার জন্য ইমিডিয়েট হাসপাতাল সাপোর্ট লাগবে। কিন্তু আমরা দেখলাম, গত কয়েক মাসে সেরকম বড় কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হইনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সারা দেশে প্রান্তিক পর্যায়ে করোনা টিকা কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে হাসপাতালভিত্তিক টিকাদান পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হবে। দেশব্যাপী আরও দ্রুত টিকাদানের মাধ্যমে ইপিআই কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হবে। এজন্য ইপিআই কর্মীদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কোভিড টিকা ব্যবস্থাপনায় ইতঃপূর্বে সম্পৃক্ত না থাকায় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়া এ কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা কঠিন। তাছাড়া বর্তমানে সরকারের তিন ধরনের টিকা রয়েছে। তিনটি টিকার ব্যবহারবিধিও আলাদা। তাই দেশব্যাপী ইপিআই কর্মীদের এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে। ৬ আগস্ট পর্যন্ত প্রশিক্ষণ চলবে। এরপর শুরু হবে টিকাদান।
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা ছাড়া সংক্রমণ রোধ সম্ভব নয়। এটা জানার পরও সংশ্লিষ্ট কর্মীদের কেন আগে থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো না, তা স্পষ্ট নয়। প্রশিক্ষণ দেওয়া থাকলে আরও আগে গ্রামে টিকা ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হতো। এতে পরিস্থিতির এত অবনতি ঘটত না। তারা বলেন, এখন যত আগে এই গণটিকা কার্যক্রম শুরু করা যাবে, ততই মঙ্গল। কারণ দেশে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপক সংক্রমণ চলছে। প্রতিদিন ১০ হাজারের বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যু হচ্ছে দুইশরও বেশি মানুষের। সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসছে না। এই মুহূর্তে গণহারে টিকাদান ছাড়া সংক্রমণ প্রতিরোদের আরও কোনো উাপায় নেই।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আহমেদ পারভেজ জাবীন যুগান্তরকে বলেন, চলমান টিকাদান প্রক্রিয়ায় ১০০৫টা বুথে ৩ লাখ ৭ হাজার ডোজ টিকা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। বর্তমানে ৪০ থেকে ৫০ হাজারের মতো টিকা দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে সপ্তাহে এক কোটি টিকাদান সম্ভব কি না, সেটিও ভাবার বিষয়। কারণ দেশের মানুষকে সচেতন করতে না পারলে টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, এ পর্যন্ত দেশের মোট ৪ দশমিক ১৬ ভাগ মানুষ এক ডোজ টিকা পেয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা সিটি করপোরেশনে এক ডোজ টিকা পেয়েছেন ১৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ঢাকা বিভাগে ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগের ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ৩ দশমিক ২১ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ৩ দশমিক ১০ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
অধিদপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, দেশে এ পর্যন্ত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৩৩ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪২ লাখ ৯৮ হাজার ৮৬ জন। ফাইজারের টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৫০ হাজার ২২৫ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ১৪৬৪ জন। সিনোফার্মের প্রথম ডোজ পেয়েছেন ২২ লাখ ৪৮ হাজার ১০৬ জন এবং দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৩ লাখ ৯৮ হাজার ৩৬ জন। এছাড়া মডার্নার টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৬ লাখ ৮৭ হাজার ৬৮১ জন, তবে এই টিকার দ্বিতীয় ডোজ এখনো দেওয়া শুরু হয়নি।
৭ আগস্ট থেকে সারা দেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বিতীয় ডোজের করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ডা. মো. শামসুল হক। তিনি বলেন, চলতি বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি আমরা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়া শুরু করি। কিন্তু টিকার স্বল্পতায় ১৫ লাখ ২১ হাজার ৯৪৭ জন দ্বিতীয় ডোজ থেকে বাদ পড়েছিলেন।
আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, জাপান সরকারের পক্ষ থেকে কোভ্যাক্সের মাধ্যমে আমরা ১০ লাখ ২৬ হাজার ৩২০ ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা হাতে পেয়েছি। আরও ছয় লাখ ডোজ আগামীকাল (আজ) আমাদের হাতে এসে পৌঁছাবে। প্রথমে যে দুই লাখ ৪৫ হাজার টিকা আমাদের হাতে এসেছিল, সেগুলো রাজধানী এবং ঢাকা বিভাগের জেলায় বিতরণ করেছি।
আশা করি, সোমবার থেকে ঢাকার সব জেলা ও সিটি করপোরেশনে অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বিতীয় ডোজ থেকে যারা বাদ পড়েছিলেন, তাদের দিতে পারব। এছাড়া ৭ আগস্ট থেকে আমরা সারা দেশে আগের কেন্দ্রগুলোয় দ্বিতীয় ডোজ দিতে পারব। একই সঙ্গে ৭ থেকে ১২ আগস্ট ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এলাকায় জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি চলবে। তবে যারা যে এলাকায় নিবন্ধন করবেন, সেই এলাকায় টিকা নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, অন্য এলাকা থেকে টিকা নিলে তার তথ্য সঠিকভাবে পাওয়া যাবে না। সনদ পেতে বিড়ম্বনায় পড়তে পারেন।
রোববার স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ৭ থেকে ১৪ আগস্ট (৭ দিনে) উৎসবমুখর পরিবেশে দেশের মানুষকে অন্তত ১ কোটি টিকা দেওয়া হবে। দেশের ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত সর্বত্র এই টিকা উৎসব চলবে। এই উৎসবে বয়স্ক মানুষকে অগ্রাধিকার দিয়ে তারপর অন্য ব্যক্তিদের টিকা দেওয়া হবে। অধিকসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনতে ন্যাশনাল আইডি কার্ড অথবা বিশেষ ক্ষেত্রে আরও সহজ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।
Array