বিষন্ন বিকেলে পরাধীন লেখক(ছোট গল্প)
-লিজি আহমেদ
চাবি ঘুরিয়ে সদর দরজাটার তালাটা খোলে অর্ক। আজ হঠাৎ করে আকাশে খুব মেঘ জমেছে তাই শেষ বিকেলেই ঘরের ভেতরটা খুব আঁধার লাগে তার। আলো জ্বালিয়ে সে এগিয়ে যায় তার লেখালেখি করার প্রিয় টেবিলটার কাছে। অসমাপ্ত একটা লেখার খোলা ডায়রীটা টেনে নিয়ে ভাবতে বসে। আজ সে লিখবে তার বহুদিনের অসমাপ্ত এক উপন্যাসের শেষ অধ্যায়। অর্ক গল্প লিখতে ভালোবাসে। ভালোবাসে লিখতে উপন্যাস। আমাদের আশেপাশে চোখের সামনে ছড়িয়ে থাকে জীবনের কত শত মধুময় দৃশ্য, কত শত প্রিয় ঘটনা। আবার চোখের আড়ালে জীবনের কত অজানা রহস্য জট বেঁধেও থাকে,তখন নিমেষেই অপ্রিয় হয়ে যায় সব দৃশ্য,সব ঘটনা।
অর্ক ভেবেছিল লেখার স্বাধীনতা যখন তার হাতে,সে ই যখন লেখক তখন উপন্যাসের পাতা তার মনের মত করেই পরিপূর্ণতা পাবে। পরিপূর্ণ থাকবে ভালোবাসায়,সেখানে কোনো শূন্যতা থাকবে না। কিন্তু আসলেই কি সব লেখকদের সে স্বাধীনতা থাকে ! না তারা বাধ্য হয়েই বিষন্নতায় ঢেকে দেন ঘটনার শেষ অধ্যায় !
মা আর ছেলের ছিমছাম সংসার ছিল তাদের। মা সংসার গুছিয়ে রাখেন,সামলে রাখেন অর্ককে। আর অর্ক সামলে রাখে মা’কে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মা’য়ের বায়না শুরু হয়,”এবার ঘরে একটা বউ আন বাবা! আমি আর কতদিন ! বউমার হাতে সংসারটা বুঝিয়ে দিতে পারলে আমি নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজতে পারি।”
ইদানিং কথা প্রসঙ্গে তাঁর ফুপাতো বোনের মেয়ে চিত্রার কথা প্রায়ই টেনে আনেন মা। গোলগাল ফর্সা,স্বাস্থ্যবতী মেয়ে চিত্রা। মা যখন চিত্রার সব গুণাগুণ বর্ণনা করতে থাকেন অর্ক বেশ বুঝতে পারে চিত্রার কারণেই মাসী আর মেসোমশাইয়ের বাড়ীতে এত কড়া শাসন। এত যত্নের ছাপ। ওদের বাড়ীর সবকিছু একটু বেশি মাত্রায় পরিপাটি, সূশৃঙ্খল। কোনো একটু অনিয়ম কোথাও স্পর্শ করার উপায় নাই। এমন একটা মেয়েকে ঘরের বউ করে আনতে পারলে নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজতেই পারেন যে কোনো মা।
এমন নিয়মের কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ হতে চায় না অর্ক। একথা মা’কে বলা হয়ে ওঠে না। বলা হয় না চিত্রাকে তার পছন্দ না। মা’য়ের প্রবল আগ্রহের কাছে হেরে যায় সে। মায়ের ইচ্ছাতেই শেষ পর্যন্ত বিয়েতে মত
দিয়ে দেয় একদিন। মায়ের প্রিয় তারিখ পহেলা ফাল্গুনে বিয়ে হয়ে যায় ওদের। বিয়ের এক মাসের ভেতর অর্ক বুঝতে পারে বড্ড ভুল হয়ে গেছে। ছাত্র বয়সে চা বা কফি খেতে চাইলে মা বেলের শরবত বা দইয়ের লাচ্ছি বানিয়ে এনে হাতে ধরিয়ে দিতেন, আর সে সব পানীয়ের গুণাগুন বিশ্লেষন করতে বসতেন। সব ব্যাপারেই মা তার ভালো চান কিন্তু বিয়ের বিষয়টায় মায়ের ইচ্ছেটার প্রাধান্য দেয়া তার ঠিক হয়নি।
রান্নাবান্না, ঘর কন্যায় ভীষন পারদর্শী চিত্রা। বাড়ীতে আত্মীয়-স্বজন এসে বলে সাক্ষাৎ লক্ষী প্রতিমা ঘরে এনেছে অর্ক। মা আহ্লাদে গদগদ হয়ে ওঠেন। তার বউমাকে নিয়ে তার আদিখ্যেতার শেষ নেই। কিন্তু অর্ক তার পরিপাটি সংসারে লক্ষী বউ নিয়ে অল্পদিনেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যখন সঙ্গীনির হাত ধরে সে হারাতে চায় দূর-দিগন্তে,গান-কবিতার বন্ধুদের আড্ডায়,হেঁটে বেড়াতে চায় সাগরের পাড় ধরে বহুদূর,জোৎস্নায় স্নান করে গানের ভেলায় ভেসে ভেসে কাটিয়ে দিতে চায় নির্ঘুম রাত। সেই সে মুহূর্তে রান্না,সেলাই, ঘর-দোর পরিষ্কার করে ক্লান্ত চিত্রা ঘুমের দেশে হারিয়ে যেতে চায়। দুজনার দুরকম ভাবনার জীবন হয়ে ওঠে প্রচন্ড একঘেয়ে আর বিরক্তিকর।
এ সময় অর্কের খুব মনে পড়ে শুভ্রার কথা। অর্কর অফিসেই কাজ করে শুভ্রা। যেমন আধুনিকতায় ঘর-দোর সাজাতে জানে, তেমনি যত্ন তার নিজের প্রতি। নাটক,সিনেমা দেখায়,বন্ধুদের আড্ডায় ওর খুব আনন্দ,আবার দিন-রাত ঘুরে বেড়ানোতে কোন ক্লান্তি নেই। কোথাও ঘুরতে যাবার কথা উঠলেই যেনো পাখির মত ডানা মেলে দেয়। অফিসে কোনো আনন্দ-আড্ডায় ওর হাসি ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোর মত যেনো ছড়িয়ে যায় সারা ঘরময়। শুভ্রা যে পথে হেঁটে যায় সে পথের বাতাসেও যেনো এক ছন্দ খেলা করে যায়।
আনন্দ-গানে মেতে থাকে পুরো পরিবেশ।
অর্ক কেবল ভাবে আমি ভুল করেছি। মনের মাঝে শুভ্রার স্বপ্ন নিয়ে চিত্রার সাথে ঘর করতে থাকে সে। পুতুলের মত একটা মেয়েকে সমাজ-সংসার বাহবা দিলেও অর্কর বুকের শূন্যতায় এক ফোটা জলও দিতে পারে না সে। চিত্রার সাথে তার তেমন কথাবার্তাই জমে না। সামান্য খুঁনসুটি তো হয়ই না। অথচ শুভ্রার সাথে কাজে-অকাজে কত না মান-অভিমানের গল্প আছে তার। সারাদিন অকারণ অভিমানের পর সন্ধ্যায় ভাব হয়ে যেতো। আবার পরদিন কথা বন্ধ। জীবনটা খুব একঘেঁয়ে, ছন্দহীন মনে হয় অর্কর। যেনো বহু যুগ যুগ ধরে তারা স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করে চলেছে।
এরই মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়লেন মা একদিন এবং খুব শান্তিতেই চোখও বু্ঁজলেন। মায়ের অবর্তমানে সংসারে আরও দম বন্ধ হয়ে আসে অর্কর। সিদ্ধান্ত নেয় যাকে ভালোবাসে না তাকে নিয়ে এভাবে জীবন টেনে নেবার কোনো মানে হয় না। চিত্রার সাথে কথা বলে সে। চিত্রা কোনো কান্নাকাটি এমনকি কোনো উচ্চবাচ্যও করে না। চুপ করে শোনে এমনভাবে যেনো এমনটি হবারই কথা ছিল। তারপর সাথে সাথেই এক কাপড়ে বেরিয়ে যায় বাড়ী থেকে।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অর্ক। এখন থেকে তার কোনো কাজের জন্য আর কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না। কেউ আর কঠিন শীতল চেহারা নিয়ে তার সব কিছুতে ছায়ার মত মাঝখানে এসে দাঁড়াবে না।
সংসারে পুরুষ মানুষের একলা থাকার সুখ অনেক কিন্তু দুঃখও কম না। যেদিন অফিস থাকে বা কোনো কাজ থাকে সেদিন স্বচ্ছন্দে কেটে যায়। ছুটির দিনে যত সমস্যা। সময় যেনো আর কাটে না। সারাদিন ঘরে কি আর এত কাজ ! একা একা সিনেমা দেখে,গান শুনে,বই পড়ে আর কত ভালো লাগে ! বন্ধু,কলিগদের থাকে স্ত্রী,সন্তানদের সাথে নানা ব্যস্ততা। কে এত সময় দেবে তাকে ! তাদের মাঝখানে অবান্চিত,কৌতুকের পাত্র মনে হয় নিজেকে। কারও খোঁজ নিতে গেলে কাছের মানুষই তাকে খোঁচা দিয়ে বলে বসে “তোর মত সুখের কপাল নিয়ে কে জন্মেছে বল ! মানুষ আমি আমার কেনো পাখির মত মন! তাইরে নাইরে নারে গেলো সারাটা জীবন!”
শুভ্রাকেও কিছু বলা হয়ে ওঠে না তার। আর কোনো ভুল হয়ে যায় কিনা এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে কেটে যায় আরও কিছু দিন, মাস, পাঁচটা বছর। শুভ্রা এরই মাঝে কি একটা কাজে ছুটি নিয়ে বেশ অনেকদিনের জন্য দেশের বাইরে চলে যায়। অর্ক নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে। প্রাপ্ত বয়সে এসে আর কোনো ভুল সিদ্ধান্তে জড়াতে চায় না সে।
দিনটা ছিল বৃহসপতিবার। শুভ্রার ব্যাঙ্কক থেকে ফেরার দিন। আর অপেক্ষা করতে পারে না অর্ক। এমনিতেই বড্ড দেরী হয়ে গেছে। ম্যাসেজ পাঠিয়ে রাখে শুভ্রাকে ,”জরুরী ভাবে দেখা করতে চায় তার সাথে।”
একদিন পর শনিবার সময় দেয় শুভ্রা। মাঝখানে একটা দিন। কিছুতেই যেনো যেতে চায় না। অবশেষে আসে সেই কাঙ্খিত ক্ষণ। নিজেকে গুছিয়ে নিতে অনেকদিন পর আয়নার সামনে দাঁড়ায় অর্ক।
কথাগুলোও গুছিয়ে নেয়। মাকে মনে পড়ে খুব। মাকে সে কষ্ট দেয়নি,অবাধ্য হয়নি বলেই আজ সে নিঃসঙ্গ। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ ছিলেন তার মা। কিন্তু তাই বলে তো তাঁর জন্য পুরোটা জীবনের ত্যাগ স্বীকার করাও সম্ভব না। মা নিশ্চই ভুল বুঝবেন না তাকে।
নদীর ধারে এক নিরিবিলি খোলামেলা রেস্টুরেন্টে দেখা করবে তারা আজ। তার চোখে সবচেয়ে সুন্দর মনের সুন্দর মেয়েটিকে আজ অর্ক বলবে তার ভালোবাসার কথা। ভেতরে ভেতরে খুব অস্থির হয়ে পড়লেও মুখে সহজাত হাসি নিয়ে এগিয়ে যায় সে। শরতের ছেঁড়া ছেঁড়া নীল-সাদা মেঘ আকাশে। তারই নিচে গাঢ় নীল শাড়ীতে নদীর পাড় ঘেষে একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসে আছে শুভ্রা। কি অপূর্ব লাগছে ওকে দেখতে। আজ সে ঘন করে কাজলে এঁকেছে তার চোখদুটো। তবু যেনো সে চোখ জুড়ে খুব গাঢ় বিষন্নতা রয়েছে যা কিছুতেই লুকোনো পারে নি শুভ্রা।
শুভ্রার সামনে এসে বসতেই মাঝখানের পাঁচটা বছরের জীবনটা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় অর্কর। মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকে শুভ্রার চোখে। অর্ক কিছু বলার আগেই শুভ্রাই অর্কর একটা হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় টেনে নেয়,খুব ধীরে ধীরে বলে ওঠে “আমি জানি কি বলবে তুমি আজ,কিন্তু তাতো হবার নয় অর্ক ! আমার যে এবার ব্যাঙ্ককে গিয়ে চেকআপে ব্লাডক্যানসার ধরা পড়েছে! ”
স্তব্ধ হয়ে সামনে তাকিয়ে থাকে অর্ক। সবকিছুই তো সচল আগের মতই। বাতাস বইছে,গাছের পাতারা সব হেলেদুলে নড়ছে। নদীর বুকে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। মানুষেরা কথা বলছে,হাসছে। শিশুরা দৌঁড়ুচ্ছে। রিকশা- গাড়ী ছুটে চলেছে। কিছুই তো মিথ্যা নয়। এই যে তার হাত শুভ্রার হাতের মুঠোয় সে স্পর্শও তো মিথ্যা নয়। তবুও যদি শুভ্রার মুখের এই নিষ্ঠুর কথাগুলো শুধু এই মুহূর্তে মিথ্যা হয়ে যেত !!!
Array